জর্জিয়ায় আন্তর্জাতিক দাবা সংস্থা (ফিডে)-র মেয়েদের বিশ্বকাপ জিতলেন ভারতের দিব্যা দেশমুখ। নানা অর্থেই এই কীর্তি ‘ইতিহাস’ গড়ার শামিল— বিশ্বকাপজয়ীদের উজ্জ্বল তালিকায় তো বটেই, আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার তালিকাতেও উঠল তাঁর নাম। তাঁর আগে দেশের মাত্র তিন জন নারী দাবাড়ু গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছেন, এবং কোনও ভারতীয় মেয়েই বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। বিশ্বকাপ জয়ের পথে যাঁদের হারিয়ে তিনি ফাইনালে উঠেছেন তাঁরা সকলেই দাবায় দুর্দান্ত প্রতিভা, দিব্যা সেখানে প্রতিযোগিতার শুরুতে ছিলেন পঞ্চদশ বাছাই, বিশ্বকাপ জয়ের আগে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাবও ছিল না তাঁর। হার না মানা মনোভাব, ঠান্ডা মাথা, প্রখর বুদ্ধি ও দূরদর্শিতা সহায়ে তাঁর ফাইনালে ওঠাটাই এক বিরাট কৃতিত্ব; তার পর আর এক ভারতীয় ফাইনালিস্ট, দাবার কিংবদন্তিপ্রতিম গ্র্যান্ডমাস্টার কনেরু হাম্পির সঙ্গে প্রথম দু’দিন ম্যাচ ড্র করার পরে শেষ দিনে র্যাপিড টাই-ব্রেকারে যে ভাবে তাঁকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতলেন, তা শুধু দাবা নয়, যে কোনও ‘স্পোর্ট’-এর খেলোয়াড়ের শিক্ষণীয়, দৃষ্টান্তস্বরূপ।
সাফল্যের আলোয় সব অন্ধকার মুছে যায়। শিখরে চড়লে খাদের দিকে আর তাকাতে বারণ করেন অনেকে। দিব্যার বয়স মাত্র উনিশ, সামনে দীর্ঘ সময় পড়ে— মুকুটে বহু সাফল্যপালক যোগ হবে নিশ্চয়ই। তবু, বিশ্বকাপ জয়ের উচ্ছ্বাসের মধ্যে তিনি এ কথাটিও মনে রাখবেন, মাত্র কয়েক মাস আগেই তাঁর মনে হয়েছিল দাবা ছেড়ে থাকার কথা— অন্তত কিছু সময়ের জন্য। সর্বক্ষণ দাবা খেলতে তিনি ক্লান্ত বোধ করছিলেন, এবং খেলায় সাফল্যের তৃপ্তির চেয়ে তিনি ব্যক্তিগত সুখবোধকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন। ভারতের মতো দেশে, যেখানে পড়াশোনা খেলা বিনোদন বা কাজের জগৎ সর্বত্র সবাই সাফল্য নিয়ে এক ধরনের ‘অবসেশন’-এ ভোগে, সেখানে ক্লান্তি, ব্যক্তিগত সুখবোধ ইত্যাদির কথা বলা— তাও আবার প্রকাশ্যে— বারণই বলা চলে, কেউ তা বললে সমাজ তাঁকে ঠাট্টায় নিন্দায় ভরিয়ে দেয়। আলোচ্য মানুষটি যদি হন সর্বোচ্চ স্তরের প্রতিযোগিতার দৌড়ে থাকা কেউ, তা হলে তো কথাই নেই। মনে রাখতে হবে, দাবা এমন এক খেলা যা খেলোয়াড়ের মানসিক শক্তি নিংড়ে নেয়। বিশ্ব স্তরে টিকে থাকতে দাবাড়ুদের বিপুল ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। ছাড়তে হয় বন্ধু, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন, পছন্দের খাবার; যেতে হয় দীর্ঘ, ক্লান্তিকর, কঠোর প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে, সঙ্গী হয় শক্ত প্রতিযোগীর মুখোমুখি হওয়ার ‘স্ট্রেস’, চাপের মুখে ভেঙে পড়েন বহু খেলোয়াড়।
দিব্যা এই সবই জানেন, তিনি নিজেও এর মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। ক্লান্ত, ব্যর্থ হয়েছেন, ফিরেও এসেছেন নবোদ্যমে। তাঁর বিশ্বকাপ জয় এমনই এক ‘প্রত্যাবর্তন’-এর দৃষ্টান্ত। তাই এই মুহূর্তের উল্লাস-উচ্ছ্বাসের মধ্যেও মনে রাখা দরকার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে, পেশা ও জীবনের সুষ্ঠু ‘ব্যালান্স’ নিয়ে, সাফল্য ও সুখের তুল্যমূল্য বিচার নিয়ে বলা তাঁরই কথাগুলো— ‘অপ্রিয় সত্য’ হওয়ার দরুন যে কথাগুলোয় সাধারণত ভারতীয় সমাজ কান দিতে চায় না, কোনও ‘সফল’ মানুষের মুখ থেকে তো নয়ই। খেলায় শিখর ছোঁয়া তারিফযোগ্য নিশ্চয়ই, সেই সঙ্গে খেলোয়াড়ের জীবন ও মনের অন্ধকার, খাদের কিনারাও সমান সত্য— তরুণ প্রজন্মের বিশ্বকাপজয়ীর মুখ থেকে এ কথা শোনাও একটা বড় শিক্ষা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)