মদ্যপানের আসরে অশান্তি থেকে হাতাহাতি, শেষ পর্যন্ত খুন, এই ঘটনাক্রম ভারতে এতই পরিচিত যে, তাতে অনেকেই আর তেমন বিচলিত হন না। অবৈধ মদের ঠেককে কেন্দ্র করে এলাকায় অসন্তোষ জমে উঠতে উঠতে কখনও বিস্ফোরণ ঘটে— তখন পুলিশ নড়েচড়ে বসে, দিনকয়েক পরিস্থিতি শান্ত থাকে; তার পর যথাপূর্বং। মধ্যমগ্রামে সম্প্রতি যে ঘটনাটি ঘটল, সে ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হবে বলে আশা করতে সাহস হয় না। সত্য হল, অবৈধ নেশার আসরে যারা এসে জোটে, তাদের অধিকাংশই সামাজিক সভ্যতার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে পছন্দ করে। তার উপরে, পেটে মদ পড়লে স্বনিয়ন্ত্রণ আরও শিথিল হয়ে ওঠে— ফলে, নেশার আসরে মারপিট, স্থানীয় মানুষের সঙ্গে গোলমাল, মহিলাদের প্রতি কটূক্তি বা অশালীন আচরণ ইত্যাদির প্রবণতা সেখানে বেশি। এ ক্ষেত্রে পুলিশের দায়িত্ব স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট— আইনরক্ষা করা। অবৈধ মদের আড্ডা যেমন বেআইনি, তেমনই অশান্তি বা অশালীনতাও আইন অনুসারে অপরাধ। কাজেই, সেগুলি দমন করতে হবে বইকি। গুরুত্ব দিতে হবে স্থানীয় মানুষের অভিযোগেও। কোনও একটি নেশার আসরকে কেন্দ্র করে যদি নিয়মিত সামাজিক পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে, তবে তাকে কঠোর হাতে দমন করতে হবে। ঠিক যেমন, চোলাই মদের ব্যবসা চলতে দেওয়া যায় না। আবার, মদ যেখানে গার্হস্থ হিংসার কারণ, সেখানেও সেই হিংসাটি অপরাধ বলেই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
প্রশ্ন হল, যে ক্ষেত্রে মদ্যপান কোনও আইনভঙ্গের কারণ হচ্ছে না, সেখানেও কি আপত্তির কোনও কারণ থাকতে পারে? লান্সেট-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে উঠে এসেছে যে, ভারতের মদ্যপায়ী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অর্ধেকের বেশিই সুরাপান জনিত সমস্যাগুলিতে আক্রান্ত। এঁরা অত্যধিক পানে অভ্যস্ত ও আসক্ত। ভারতের হাসপাতালগুলিতে এক-পঞ্চমাংশ রোগীই মদ্যপান উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে ভর্তি হন। পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী পুরুষের মদের নেশা বহু ক্ষেত্রেই গোটা পরিবারের জন্য আর্থিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে পরিবারের অন্যদের উন্নয়ন সম্ভাবনা। এই ঘটনাগুলি ঠেকাতেও কি মদের উপরে কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকা উচিত নয়?
ভারতীয় সমাজ এবং রাজনীতিতে এই প্রশ্নটি বহু পুরনো, এবং অতি তাৎপর্যপূর্ণ। এতখানিই যে, ঔপনিবেশিক আমলে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি যখন ভবিষ্যৎ স্বাধীন স্বনিয়ন্ত্রিত দেশের কল্পনা করেছে, সেখানেও ঠাঁই পেয়েছে মদের উপরে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করার পরিকল্পনা। ভারতীয় সংবিধানের ৪৭তম ধারায় নির্দেশমূলক নীতির অন্তর্গত মদ নিষিদ্ধ করার কথা। গুজরাত বা বিহারের মতো রাজ্যে মদ নিষিদ্ধ। কিন্তু, এই দাবিটির মধ্যে একটি বিশেষ গোত্রের নৈতিকতা-তাড়িত আবেগ যতখানি আছে, প্রাপ্তমনস্ক উদারবাদী গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা সে তুলনায় কম। ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত পরিসরে কী করবে, সেটা রাষ্ট্র ঠিক করে দিতে পারে না। সেই আচরণের ক্ষতিকর দিকগুলির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে, সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারে— কিন্তু, যত ক্ষণ না সেই আচরণ কোনও আইনভঙ্গ করছে, তত ক্ষণ শেষ সিদ্ধান্ত ছাড়তে হবে ব্যক্তির উপরেই। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ন্ত্রণের নীতিটি সর্বদাই বর্জনীয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)