E-Paper

গরহাজির

পশ্চিমবঙ্গে বহু ব্যয়ে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল নির্মাণ, দামি যন্ত্র ও প্রযুক্তি জুগিয়েও বেসরকারি চিকিৎসার প্রসার আটকানো যায়নি। চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির নানা কারণ রয়েছে, যার মধ্যে প্রধান নজরদারির অভাব।

শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:১৯

রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে শিক্ষক-চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির যে চিত্র সম্প্রতি উঠে এসেছে সংবাদ প্রতিবেদনে, তা উদ্বেগজনক। উদ্বেগ কেবল সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা নিয়েই নয়, মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়েও। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল ইতিমধ্যেই শিক্ষক-চিকিৎসক, রেসিডেন্ট ডাক্তার, টিউটরদের অনুপস্থিতি নিয়ে বেশ কিছু মেডিক্যাল কলেজকে কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠিয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা দিল্লিতে গিয়ে কাউন্সিলে দরবার করে এসেছেন। কিন্তু কেন্দ্র যে ভাবে অনিয়ম, দুর্নীতি দর্শিয়ে রাজ্যের নানা প্রাপ্যের পথ রুদ্ধ করার পথ নিয়েছে, তাতে শিক্ষক অনুপস্থিতির কারণকে সামনে রেখে এমবিবিএস পাঠক্রমের পুনর্নবীকরণ বাতিল করে দিতে পারে কাউন্সিল, সে আশঙ্কা জাগতে বাধ্য। তাতে কয়েকশো মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ অথৈ জলে পড়বে। এমন ঝুঁকির সামনেও কী করে শূন্য উপস্থিতি, অথবা মাসে দশ-বারো দিন উপস্থিত থেকে এক-এক জন শিক্ষক-চিকিৎসক মাসের পর মাস পূর্ণ বেতন পেয়ে যাচ্ছেন? কী করে তাঁদের নির্দিষ্ট ডিউটির সময়ে অবাধে প্র্যাক্টিস চালিয়ে যাচ্ছেন হাসপাতালের আশেপাশের চেম্বার, নার্সিং হোমে? এঁদের মধ্যে অনেকে ‘নন-প্র্যাক্টিসিং’ ভাতাও গ্রহণ করছেন, যার অর্থমূল্য বেতনের উপর আরও কুড়ি হাজার থেকে চল্লিশ হাজার টাকা। এক দিকে করদাতার টাকার বিপুল অপচয় হচ্ছে, অন্য দিকে মেডিক্যাল কলেজগুলির শিক্ষা ও চিকিৎসার মানে ঘাটতি বজায় থাকছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। কী করছেন স্বাস্থ্যকর্তারা?

প্রহসন এই যে, এ বছর জানুয়ারি মাসেই স্বাস্থ্য দফতর সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নির্দেশাবলি জারি করেছিল। নিয়মের বজ্র-আঁটুনির মধ্যেই ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে ফস্কা গেরো। যেমন, সরকারি হাসপাতালের যে চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করেন, কোনও ইমার্জেন্সিতে তলব করলে তাঁদের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে হাজিরা দিতে হবে। এর মানে কী? ইমার্জেন্সি পরিস্থিতি দেখা দিলে কি চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করা চলে? তেমনই, নিজের কর্মক্ষেত্র হাসপাতালের কুড়ি কিলোমিটারের মধ্যে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করতে হবে, এই নির্দেশও অর্থহীন হয়ে যায়, যদি নজরদারি না থাকে। মেডিক্যাল কলেজে উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য কত না উপায় এখন বলবৎ রয়েছে— বায়োমেট্রিক ছাপ, ফেস রেকগনিশন প্রযুক্তি, হাজিরা খাতায় সই। চিকিৎসকরা এর প্রতিটিকেই নানা কৌশলে ফাঁকি দিয়ে চলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসকদের এই অভ্যাস নতুনও নয়। সরকারি চিকিৎসার প্রতিটি স্তরে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অনুপস্থিতি দেশের স্বাস্থ্য-সঙ্কটের অন্যতম কারণ। ২০১১ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ভারতের উনিশটি রাজ্যের ১৪০০ সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সমীক্ষা করে দেখেছিলেন, গড়পড়তা দিনে ৪০ শতাংশ ডাক্তার উপস্থিত থাকেন না। ফার্মাসিস্ট, ল্যাব টেকনিশিয়ানদের মধ্যেও গরহাজিরার হার বেশ উঁচু। সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলির দূরত্ব খুব বেশি নয়, খরচও কম, তাই খাতায়-কলমে সেগুলো জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকর হওয়ার কথা। বাস্তবে সাধারণ মানুষ অনেক বেশি টাকা দিয়ে বেসরকারি চিকিৎসার দ্বারস্থ হন, ডিগ্রিহীন চিকিৎসকদের কাছে যান।

পশ্চিমবঙ্গে বহু ব্যয়ে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল নির্মাণ, দামি যন্ত্র ও প্রযুক্তি জুগিয়েও বেসরকারি চিকিৎসার প্রসার আটকানো যায়নি। চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির নানা কারণ রয়েছে, যার মধ্যে প্রধান নজরদারির অভাব। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেছেন, চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির দায় নিতে হবে বিভাগীয় প্রধানদেরও। কিন্তু প্রধান কিংবা অধ্যক্ষের কি বাস্তবিক সেই প্রশাসনিক ক্ষমতা স্বাস্থ্য দফতর দিয়েছে? গলদ এতগুলি স্তরে যে তার নিরাময় অত্যন্ত জটিল।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Doctors Professor Medical Council

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy