E-Paper

চপেটাঘাত

আমেরিকার প্রায় সাত লক্ষ ত্রিশ হাজার এইচ-ওয়ান বি ভিসা-প্রাপ্ত কর্মীর মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি ভারতীয়। মূলত আইটি কর্মী থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা সব ক্ষেত্রে তাঁরা ছড়িয়ে আছেন।

শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৫:৩০

ইতিহাস বলে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের প্রথম আশ্রয়বাক্যই হল, আইন মানার কাজ শাসকের নয়, শাসককে মানার জন্য আইন-ই জায়গা বানিয়ে নেবে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তাঁর সাম্প্রতিক কাজকর্মে কথাটির গুরুত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছেন। যে ভাবে তিনি তাঁর দেশে প্রতিটি এইচ-ওয়ান বি ভিসার জন্য কোম্পানির তরফে এক লক্ষ ডলার মূল্য ধরে দেওয়ার ঘোষণা করলেন, ও-দেশের বর্তমান আইনে সেই ঘোষণার অধিকার প্রকৃতপক্ষে প্রেসিডেন্টের এক্তিয়ার-বহির্ভূত; সে অধিকার কেবল মার্কিন কংগ্রেসের। কিন্তু ট্রাম্পের মতো শাসকরা মূলগত ভাবেই গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী, তাঁদের জন্য নীতি বা রীতি সম্পূর্ণ অর্থহীন। ফলে এখন আদালতের চত্বরে অপেক্ষমাণ প্রেসিডেন্টের এক্তিয়ার বিষয়ক মীমাংসাটি। আদালত যা-ই বলুক, সম্ভবত তার পরও কোনও না কোনও আইনের ফাঁক বার করে ঘোষণাটি বহাল রাখা হবে— ঠিক যেমন বেআইনি অভিবাসীদের দেশ থেকে বলপূর্বক বার করে দেওয়া, তাদের সঙ্গে অমানবিক ব্যবহার করার কোনও নিদান আমেরিকার আইনবিধিতে না থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধকালীন একটি পুরনো আইন বার করে এনে তার সাহায্যে আমেরিকা জুড়ে বেআইনি অভিবাসী নিপীড়ন চলছে। এইচ-ওয়ান বি ভিসার ক্ষেত্রেও এমন আশঙ্কাতেই এখন বিরাট আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়েছে আমেরিকা পেরিয়ে অন্যান্য দেশেও, ভারতেও।

আমেরিকার প্রায় সাত লক্ষ ত্রিশ হাজার এইচ-ওয়ান বি ভিসা-প্রাপ্ত কর্মীর মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি ভারতীয়। মূলত আইটি কর্মী থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা সব ক্ষেত্রে তাঁরা ছড়িয়ে আছেন। কর্মী-পিছু এই পরিমাণ ডলার (অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মীর বেতনের থেকেও বেশি) দেওয়া যে কোনও কোম্পানির পক্ষেই প্রায় অসম্ভব, সুতরাং ধরে রাখা যায় যে ব্যাপক হারে বিদেশি কর্মী কাটাছাঁটা শুরু হবে। যদিও আমেরিকার প্রশাসন ট্রাম্পের ঘোষণার পর জানিয়েছে যে, বর্তমান কর্মীদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না, কেবল একুশে সেপ্টেম্বরের পর থেকেই এই নিয়ম প্রযোজ্য, কিন্তু এ নিয়েও যথেষ্ট অনিশ্চয়তা এবং ভাষার অস্পষ্টতা থাকায় কোম্পানিগুলি নির্দেশ জারি করেছে, কর্মীরা যেন সে-দেশ না ছাড়েন। অনেকেই ভ্রমণসূচি বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছেন, পারিবারিক দায়িত্ব মুলতুবি রাখছেন, অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছেন। ভিন দেশে পাড়ি দেওয়ার পিছনে আমেরিকার জীবনযাপনের প্রতি দুর্দমনীয় মোহ নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু এও ঠিক, উৎকর্ষসাধনার ক্ষেত্রে সম্মানদায়ী ও অর্থকরী ভাবে কাজ করার আকর্ষণকেও অন্যায্য বলা যায় না। বিশ্বায়িত সমাজে আন্তর্জাতিক অভিবাসন অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই ব্যক্তিগত সঙ্কটের দিকটি যত সহজে দৃশ্যমান, সমাজ-অর্থনীতিগত সঙ্কট কী ভাবে অনুভূত হবে, এই নিয়ে আশঙ্কিত আলোচনা এখন বিশ্বব্যাপ্ত।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদী মহলের আশ্বাস, দক্ষ কর্মীরা ভারতে ফিরে এলে দেশের মুখোজ্জ্বল হবে। আশ্বাসদায়ীদের মনে করানো দরকার, তার জন্য প্রয়োজন, দেশের মুখোজ্জ্বল করার মতো কর্মক্ষেত্র নির্মাণ। বর্তমান ভারতীয় সরকার একই সঙ্গে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির গবেষণায় অর্থসহায়তা বিপুল ভাবে হ্রাস করবে, আবার অন্য দিকে লক্ষ-লক্ষ প্রযুক্তিকর্মী, বিজ্ঞানকর্মীর জন্য কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে, দুই লক্ষ্য একই সঙ্গে সাধনযোগ্য নয়। আধুনিক কর্মক্ষেত্রে উৎকর্ষের জন্য আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক সমাজভাবনা দরকার, ভারত যে ক্ষেত্রে দ্রুতগতিতে পশ্চাদপসরণ করছে। ভারতের ‘চরম শত্রু’ চিন বরং বহু যোজন এগিয়ে। আমেরিকার নতুন রক্ষণশীলতার স্রোত চিনের বাজার এবং কর্মক্ষেত্র, উভয়ের পক্ষেই সুসংবাদ বহন করে আনতে চলেছে। আমেরিকার নিজের সমাজ ও অর্থনীতিতেও ট্রাম্পনীতির বিষম ফল পড়বে, সন্দেহ নেই। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ (মাগা) নীতি শুনতে আকর্ষক হতে পারে, কিন্তু যে দক্ষতা ও উৎকর্ষের মান এত দিন আয়ত্তাতীত ছিল, রাতারাতি তা আয়ত্ত করা সহজ নয়, সম্ভবও নয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

US Visa america

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy