ভারতের সংবিধানে ধর্মাচরণের স্বাধীনতা বিষয়ে যা বলা আছে তার আলোচনায় একটি কথা কেন্দ্রের শাসক দলের রাজনীতিকরা এড়িয়ে যান: ধর্মাচরণের স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছায় ও বিনা বাধায় অন্য ধর্ম গ্রহণের স্বাধীনতাও। কেন এড়িয়ে যান তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। এটি মানলে এই ভারতে হিন্দু বা অন্য যে কোনও ধর্মাবলম্বী নাগরিকেরই অন্যতর কোনও ধর্ম গ্রহণের স্বাধীনতাকে স্বীকার করতে হয়, আর তা করলে ধর্মীয় রাজনীতির, বিশেষত হিন্দুত্বের রাজনীতির চলবে কেন। তার কাছে ইসলাম বা খ্রিস্টধর্ম মাত্রেই বহিরাগত, সুতরাং ‘বিধর্ম’, সুদূর অতীতে কারা কবে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন সে অন্য কথা, এখনকার ভারতে তা আর চলবে না। সে জন্যই বিজেপি জমানায় এই মুহূর্তে সাতটি রাজ্যে ধর্মান্তরণ বিরোধী আইন চালু, অরুণাচল প্রদেশে আইনটি পাশ হলেও, এত দিন কার্যকর হয়নি। ১৯৭৮ সালে পাশ হওয়া, কিন্তু এ-যাবৎ কার্যকর না হওয়া ‘অরুণাচল প্রদেশ ফ্রিডম অব রিলিজিয়ন অ্যাক্ট’ (এপিএফআরএ)-এর বিধি প্রণয়ন করে তা কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
সত্তর দশকে আইনটি পাশ হয়েছিল অরুণাচলের জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষ ও তাঁদের নিজস্ব ধর্মাচরণকে ‘রক্ষা’ করতে। কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় খ্রিস্টধর্ম ও চার্চের বলপূর্বক ধর্মান্তরণকে। ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী অরুণাচলে খ্রিস্টানরা প্রায় ৩০ শতাংশ, হিন্দুরা গায়ে গায়েই, তার পর জনজাতি ধর্মবিশ্বাসের মানুষ। তাই ২০২৫-এ আবারও খ্রিস্টধর্মের দিকে আঙুল ওঠাটা যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা নিয়ে সন্দেহ নেই। অরুণাচলের নিজস্ব ধর্ম-সংস্কৃতির মানুষদের সংগঠন আইএফসিএস-এর সাম্প্রতিক আরএসএস-বিজেপিপ্রীতি চোখে পড়ার মতো। মুখে অরুণাচলের নিজস্ব ধর্ম-সংস্কৃতি রক্ষার কথা বললেও বেশ কিছু বছর ধরেই তারা অরুণাচলের জনজাতি সমাজে হিন্দু রীতি প্রথাসিদ্ধ করে তুলছে, জনজাতি দেবতা/ঈশ্বরের রূপকে করে তুলছে হিন্দু মূর্তিতত্ত্ব-ঘেঁষা। আরএসএস-প্রধানের সঙ্গে তাদের সাম্প্রতিক সাক্ষাৎ, তাদেরই তরফে আদালতে জনস্বার্থ মামলা এবং তার জেরে প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো আইন কার্যকর করার নির্দেশ: ঘটনাক্রমই বোঝায়, আড়ালে কলকাঠি নাড়ছে কারা।
আশঙ্কা, অরুণাচল পাছে আর একটি মণিপুর হয়ে ওঠে। এর মধ্যেই অরুণাচলে খ্রিস্টানদের সংগঠন প্রতিবাদ-মিছিল করেছে— এই আইনে রাজ্যের জনজাতি ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে তাঁদের কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে, এই অভিযোগে। কুকি-মেইতেই সংঘর্ষে কত জীবন চলে গেল, কত মানুষ ঘরছাড়া হলেন, সেই উদাহরণটি চোখের সামনে। তা থেকেও যদি অরুণাচল শিক্ষা না নেয়, তা হবে দুর্ভাগ্যের। রাজ্যে ক্ষমতাসীন পেমা খান্ডুর বিজেপি সরকার দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে ক্রমশ প্রকট হয়ে ওঠা বিভেদ মুছতে পদক্ষেপ করবে বলে বিশ্বাস হয় না। লাভ জেহাদই হোক বা এনআরসি-সিএএ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধিই হোক বা ধর্মান্তরণ বিরোধী আইন, ধর্মীয় মেরুকরণ বিজেপির বড় রাজনৈতিক অস্ত্র— উত্তরপ্রদেশ, মণিপুর কি অরুণাচলে তফাত নেই কোনও। অরুণাচলের মানুষ এত কাল নানা ধর্ম-সংস্কৃতির বৈচিত্র স্বীকার ও উদ্যাপন করেই বাঁচছিলেন, সেই বহুত্ববাদের সামনে এ এক অশনি সঙ্কেত— দেশের আরও অনেক জায়গার মতোই।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)