E-Paper

বিরল

পহেলগামের সন্ত্রাসবাদী হামলায় ছাব্বিশ জন মানুষের মৃত্যুর পর জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার বলা কথাগুলিই শুধু নয়, কথা বলার ভঙ্গিটিও বিরল ব্যতিক্রমী।

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০২৫ ০৭:০৭

আমারও ব্যর্থতা আছে,’ ‘আমার ক্ষমা চাওয়ার ভাষা নেই’— ভারতে শেষ কবে একটি নির্বাচিত সরকারের প্রধান তথা এক জন জনপ্রতিনিধিকে প্রকাশ্যে এই ভাষায় কথা বলতে দেখা গিয়েছে? পহেলগামের সন্ত্রাসবাদী হামলায় ছাব্বিশ জন মানুষের মৃত্যুর পর জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভার বিশেষ অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লার বলা কথাগুলিই শুধু নয়, কথা বলার ভঙ্গিটিও বিরল ব্যতিক্রমী। অথচ, এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই যে, পহেলগাম-কাণ্ড নিরাপত্তার যে ফাঁক প্রকট করে দিয়েছে, তার দায় ওমর সরকারের উপর বর্তায় না— কাশ্মীরে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগ নেই। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল কাশ্মীরে সেনা নিযুক্ত কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা বিভাগের, আধাসেনা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে; পুলিশি ব্যবস্থাও লেফটেন্যান্ট গভর্নরের আওতায়। এদের সবার উপস্থিতিতে (কার্যকালে অনুপস্থিতিতে) বৈসরনে ঘটে গেল ভয়ঙ্কর ঘটনা। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, পর্যটনমন্ত্রী হিসেবে কাশ্মীরে বেড়াতে আসা মানুষগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তাঁর দায়িত্ব ছিল, সে কাজে তিনি ব্যর্থ, তিনি ক্ষমাপ্রার্থী।

ভারতীয় রাজনীতিতে, বিশেষত সাম্প্রতিক কালের রাজনীতিতে এই ক্ষমাপ্রার্থনার ভাষা ও ভঙ্গিটি বিরল থেকে বিরলতর হয়ে উঠেছে। সেই কারণেই তা নিয়ে কথা বলা দরকার আরও। রাজনীতিতে ক্ষমাপ্রার্থনার এক বিশেষ গুরুত্ব আছে, মাঝে মাঝে তার প্রয়োগও চোখে পড়ে, কিন্তু প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা নেতা-মন্ত্রী ও তাঁদের দলের তাৎক্ষণিক ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এর বা সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার— সর্বদাই পরিস্থিতি-সাপেক্ষ। জনপ্রতিনিধিদের কখনও নাগরিকদের সামনে এসে বলতে শোনা যায় না ‘আমি ভুল করেছি’; নানা ওজর-অজুহাতে মুড়ে কোনও মতে ‘একটা ভুল হয়ে গেছে’ বলতে পারাতেই তাঁদের কাজ ও দায়টি সারা হয়ে যায়। সাম্প্রতিক ভারতে যে রাজনীতির বয়ান ছড়ি ঘোরাচ্ছে তার প্রধান— কার্যত একমাত্র— সুরটি বিষাক্ত পৌরুষের; ক্ষমা চাওয়ার মতো একটি কাজ সেই ফিতেয় মাপা পৌরুষের পরিপন্থী। এই পরিস্থিতিতে যখন এমন কিছু ঘটছে যা নাগরিকের স্বার্থ তো বটেই, এমনকি তার জীবনেরও হানি ঘটাচ্ছে, তখনও এই রাষ্ট্রনেতারা সর্বদলীয় বৈঠকের চার দেওয়ালের বাইরে জনতার সামনে এসে এই কথাটুকু পর্যন্ত বলতে পারছেন না যে কোথাও একটা বড় ভুল হয়ে গিয়েছে, আমরা ব্যর্থ, নাগরিকেরা আমাদের ক্ষমা করুন।

ওমর আবদুল্লার ক্ষমাপ্রার্থনাটি দিল্লির অধীশ্বরদের দায়ভাগ কমানোর একটি নির্দেশিত কৌশল কি না, সে প্রশ্ন হওয়ায় ভাসছে। কিন্তু, তা-ও যদি হয়, নাগরিকের কাছে প্রকাশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনার মহিমা তাতে খর্ব হয় না। বস্তুত, এই ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্যে নিহিত আছে গণতন্ত্রের মূল সুর— এখানে জনগণ এবং তাঁদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একটি যৌথ ব্যবস্থার অংশীদার; এ সম্পর্ক রাজা ও প্রজার উচ্চাবচতার নয়, সম্পর্কটি রাষ্ট্রচালক ও নাগরিকের সমাবস্থানের। এই শাসনব্যবস্থায় নাগরিকরা রাষ্ট্রপরিচালকদের উপরে নির্দিষ্ট দায়িত্ব আরোপ করেন— জনগণের অছি হিসাবে সেই দায়িত্ব পালনই নেতা-মন্ত্রীদের কাজ। সে কাজে ব্যর্থ হলে ক্ষমা চাওয়াই স্বাভাবিক। দুর্ভাগ্য, রাজনৈতিক পৌরুষের দাপটে সেই স্বাভাবিকতা দেশ বিস্মৃত হয়েছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Omar Abdullah JammuKashmir

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy