অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদকে ঘিরে গত কয়েক দিন ধরে যে সঙ্কট চলছে, আপাতত তার সমাধান এনেছে সুপ্রিম কোর্টে অন্তর্বর্তী জামিন। সমাজমাধ্যমে অপারেশন সিঁদুর নিয়ে পোস্টের জেরে তাঁর বিরুদ্ধে দু’টি এফআইআর হয়; একটি এক বিজেপি নেতার, অন্যটি হরিয়ানা রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রধান রেণু ভাটিয়ার, অভিযোগ— মাহমুদাবাদ একটি সমাজমাধ্যম পোস্টে কর্নেল সোফিয়া কুরেশি তথা ভারতের নারী সেনানীদের অসম্মান করেছেন। এর পরই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে হরিয়ানা পুলিশের গ্রেফতারি, তা এড়াতে শীর্ষ আদালতে অধ্যাপকের আবেদন, শুনানি, পরে জামিন। জামিন মিলেছে কঠিন শর্তে: মাহমুদাবাদকে তাঁর পাসপোর্ট জমা দিতে হবে; মামলাধীন বিষয়ে তিনি বক্তৃতা করতে, নিবন্ধ লিখতে, সমাজমাধ্যমে মন্তব্য করতে পারবেন না, সন্ত্রাসবাদী হামলা ও ভারতের পাল্টা জবাব প্রসঙ্গে বক্তব্যও জানাতে পারবেন না। উপরন্তু, শীর্ষ আদালত নির্দেশ দিয়েছে হরিয়ানা ও দিল্লির বাইরের, ডিজিপি স্তরের তিন পুলিশকর্তাকে নিয়ে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গড়তে: যে পোস্ট নিয়ে এত কিছু, তার ভাষা তাঁরা খতিয়ে দেখবেন; অপরাধমূলক আর কিছু পেলে অন্তর্বর্তী রায়ে বদলও চাওয়া যাবে।
ভারতীয় নাগরিক জানেন, আদালতের রায়ের ভিত্তি, প্রথমত ও শেষত, দেশের সংবিধান। নাগরিক আস্থা রাখেন ভারতীয় সংবিধানের প্রাণভোমরা ১৯ নম্বর ধারার উপর, যার মূল সুর নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। শেষ অবধি তা অক্ষুণ্ণ রাখা যাবে কোন পথে, ভারতবাসী আশা করেন, সর্বোচ্চ আদালতেই তা স্থির হবে। তবে এই মুহূর্তে মতপ্রকাশের অধিকার যে আজকের ভারতে সর্বত্র সর্ব স্তরে বিপুল ভাবে বিপন্ন, বিশেষত নাগরিকের মতটি সংখ্যাগুরু বা জনপ্রিয় বয়ানের বিরুদ্ধ বা অপ্রিয় হলেই যে হেনস্থা অবশ্যম্ভাবী— তা নিঃসন্দেহে এক গভীর অসুখ যার নিরাময়ের পথটি সহজ নয়। মাহমুদাবাদ ফেসবুকে লিখেছিলেন, কেন্দ্র যে ভাবে কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে সামনে এনেছে তা ‘দ্বিচারিতা’ ও ‘লোক দেখানো’র নামান্তর; যে দক্ষিণপন্থীরা এ কাজের প্রশংসা করছেন তাঁরা গণপ্রহার, বুলডোজ়ার-অভিযান ও ঘৃণার রাজনীতির শিকার সংখ্যালঘুদের রক্ষার দাবি তুললে বরং সেটাই হবে প্রকৃত দেশপ্রেম। এর কোনও কথার মধ্যেই উগ্রতা, প্ররোচনা ও নারীবিদ্বেষের নামগন্ধ ছিল না, বাস্তবিক বহু নাগরিক দেশের বহু প্রান্তে এমন কথা বলেছেন, লিখেছেনও। তা সত্ত্বেও এ জন্য তাঁকে মহিলা কমিশন তলব করল, পুলিশ গ্রেফতারও করল। স্মরণ না করে পারা যায় না যে, পাশাপাশি, মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রী বিজয় শাহ কর্নেল কুরেশির ধর্মপরিচয় বোঝাতে তাঁকে ‘সন্ত্রাসবাদীদের বোন’ বলা সত্ত্বেও বিজেপি-শাসিত মধ্যপ্রদেশ সরকার কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করেনি, রাজ্য হাই কোর্টের হস্তক্ষেপে পরে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এফআইআর হলেও তিনি গ্রেফতার হননি। সুপ্রিম কোর্ট শাহের দুঃখপ্রকাশ গ্রহণ করেনি, তাঁকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছে। কিন্তু দিনশেষে সত্য এটাই— স্পষ্টত বিদ্বেষনিষিক্ত মন্তব্যের পরেও তিনি মুক্ত নাগরিক। কিন্তু মাহমুদাবাদ এক জন বিপন্ন জামিন-প্রাপ্ত তদন্তাধীন নাগরিক।
কয়েক দিনের ব্যবধানে দু’টি ঘটনা থেকে এমন নির্ণয় কি অসঙ্গত যে, আজকের ভারতে সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমান সুরক্ষিত নয়? শাসক বা রাষ্ট্রের হাতে হয়তো কখনওই নাগরিকের সুরক্ষা খুব নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত থাকে না। কিন্তু বর্তমান ভারত এক ভিন্ন স্তরে উন্নীত। এখন রাজনীতির ‘প্রয়োজন’-এ সমাজমাধ্যমের মন্তব্যকেও রাষ্ট্রদ্রোহ দাগিয়ে নাগরিককে বন্দি করা হয়। আবার সেই একই রাজনীতির ‘প্রয়োজন’-এ তীব্র হিংসার কারবারিরা শাসকের ঢালাও অনুমোদন পেয়ে যান। তবু, শেষ অবধি এই সঙ্ঘবদ্ধ বিদ্বেষ ব্যক্তিনাগরিককে চূর্ণবিচূর্ণ করবে না, আদালতেরই উপর নাগরিক সমাজের সেই আস্থা ন্যস্ত।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)