Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Refugees

ঘরে-বাহিরে

রাষ্ট্রই নানা আচরণে তাঁহাদের ঘর ছাড়িতে বাধ্য করিতেছে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২১ ০৬:১২
Share: Save:

ঘরবন্দিত্বের যুগেও ঘরছাড়ার স্রোত অব্যাহত। বিশ্ব উদ্বাস্তু দিবসে রাষ্ট্রপুঞ্জ জানাইল, ধারাবাহিক নয় বৎসর যাবৎ বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়িতেছে। ২০২০ সালে তাহা আট কোটি ছাড়াইল। উত্তর আফ্রিকার ইথিয়োপিয়ায় গৃহযুদ্ধ এড়াইতে পার্শ্ববর্তী সুদানে আশ্রয় লইয়াছেন কয়েক লক্ষ মানুষ, মোজ়াম্বিকের প্রাণঘাতী হিংসা প্রতিবেশী অঞ্চলে পাঠাইয়াছে আরও কয়েক লক্ষকে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এক দশক পার করিতে চলিল, নূতনতর সংঘাতে উত্তপ্ত আফগানিস্তান ও মায়ানমার। সমস্যা এখন জটিলতর— অতিমারি পরিস্থিতিতে সীমান্ত বন্ধ করিয়াছিল ১৬০টি দেশ, বহু উদ্বাস্তু মানুষের আশ্রয় খুঁজিবার সম্বলটুকুও প্রায় হারাইয়া গিয়াছে। এই বৈপরীত্য বিষয়ে অবগত রাষ্ট্রপুঞ্জও; তাহারা রাষ্ট্রনেতাদের প্রতি শান্তি, স্থিতি ও সহযোগিতার আর্জি জানাইয়াছে। যদিও আশঙ্কা হয়, যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এযাবৎ কাল যুদ্ধ জারি রাখিল, তাহাই এই অতিমারি-বিধ্বস্ত সময়ে আশ্রয়প্রার্থী হইতে মুখ ফিরাইবে— উদ্বাস্তু-স্রোত রুখিবার প্রশ্নই নাই।

আশ্চর্য পরিহাস! যে রাষ্ট্র নাগরিকের জীবন ও জীবিকা রক্ষার্থে তাঁহাদের ঘরে থাকিবার নির্দেশ দিয়াছে, সেই রাষ্ট্রই নানা আচরণে তাঁহাদের ঘর ছাড়িতে বাধ্য করিতেছে। নাগরিকের সহিত রাষ্ট্রের আচরণ কখন কোন তারে বাঁধা থাকিবে, তাহার উপর নাগরিকের নিয়ন্ত্রণ সামান্যই। কোথাও এক নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করা রাজনীতির আয়ুধ, কোথাও আবার বহিরাগত বিপন্ন জনগোষ্ঠীর মুখের উপর দরজা বন্ধ করিয়া দেওয়াই ক্ষমতাসীনদের তুরুপের তাস। তুরস্কের প্রেসিডেন্টের ইউরোপে উদ্বাস্তু ‘পাঠাইয়া’ দিবার হুমকি বিশ্ববাসী কি ভুলিতে পারেন? যদিও রাজনীতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা কিছু মনোনিবেশ করিলে দেখিতে পারিতেন, যে সমাজ যতখানি সহানুভূতির সহিত অতিমারির বিরুদ্ধে লড়িয়াছে, যাহারা যত বেশি দুর্বল ও বিপন্নকে রক্ষার চেষ্টা করিয়াছে, তাহারা তত ভাল ভাবে এই সংগ্রামে জয়ী হইতেছে। কিন্তু মনোযোগ বস্তুটি রাজনীতিকদের মধ্যে সুলভ নহে, সহানুভূতি দূরের কথা। তাঁহারা যে কোনও প্রশ্নকেই তাৎক্ষণিক লাভ-ক্ষতির নিক্তিতে যাচাই করিয়া লন। বিশ্ব-উষ্ণায়ন বা ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসাম্য যেমন, উদ্বাস্তু নামক মানব-সঙ্কটটিও তেমনই— নির্বাচনের ফলের উপর প্রশ্নটির কী প্রভাব, নেতাদের নিকট প্রধান বিবেচ্য তাহাই।

সমাজ কিন্তু এতখানি নিস্পৃহ থাকিতে পারে না। বিগত বৎসর গৃহাভিমুখী পরিযায়ী শ্রমিকের স্রোত জনমানসে মুছিয়া যায় নাই। কিন্তু, সমগ্র যদিও বা সমাজের আশ্রয় পাইয়া থাকে, ব্যক্তির সুবিধা-অসুবিধা, সমস্যা-যন্ত্রণার দিকে নজর রাখিবে কে? রাষ্ট্রপুঞ্জ জানাইয়াছে, গৃহহারা মানুষ সংখ্যামাত্র নহেন, প্রতিটি ঘর হারাইবার পশ্চাতে একটি ভয়াবহ যন্ত্রণার কাহিনি আছে। সেই কাহিনি কে লিখিবে জানা নাই, কিন্তু এই স্বীকৃতিটুকু তাৎপর্যপূর্ণ। যাঁহারা ঘর হারাইতেছেন, কখনও চিরকালের জন্য দেশ ছাড়িতেছেন, তাঁহারা যে কেবল রাজনীতির ঘুঁটি নহেন, সেই দ্যোতনাই বহন করে এই বিবৃতি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধশেষে এগারো জন জীবিতের নাম জানা গিয়াছিল, সংখ্যা হইয়া রহিয়া গিয়াছিলেন প্রায় চল্লিশ লক্ষ মৃত যোদ্ধা। এই যুগেও রাজনীতির কোন্দল এই ভাবেই চলিতে থাকে, মৃতদের মূল্যেই। অতিমারির গৃহবন্দি দশার মধ্যেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Refugees COVID19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE