জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই বিশেষজ্ঞদের দাবি— এটি শুধুমাত্র পরিবেশগত বিপর্যয় নয়, মানবাধিকারগুলিরও বিপর্যয়। আর এর দাপটে মানবসমাজের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা শিশুদের। ঠিক এই কারণেই ইউনিসেফ-এর পক্ষ থেকে জলবায়ু পরিবর্তনকে ‘শিশু-অধিকারগুলির সঙ্কট’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহ, বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় কী ভাবে শিশুদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায় ভারতের সুন্দরবন অঞ্চলের দিকে তাকালেই। দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে সেখানকার শৈশবের স্বাভাবিক নিশ্চিন্ত আশ্রয়, পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ। আয়লা, আমপান-পরবর্তী সময়ে সেখানে বেড়েছে শিশুপাচার, স্কুলছুটের সংখ্যা। হতদরিদ্র মা-বাবা সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছেন, সেই নজিরও অজস্র। সম্প্রতি এই বিষয়গুলিই আলোচনায় উঠে এল কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায়, যার নামটিই ছিল— ‘সংবাদমাধ্যম, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সুন্দরবনের শিশু অধিকার’।
জলবায়ু পরিবর্তন যে বিভিন্ন ভাবে শিশুদের জীবন বিপর্যস্ত করছে তার মধ্যে অন্যতম হল, তার স্বাস্থ্য এবং মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রটি। চরম আবহাওয়া বিপুল সংখ্যক পরিবারকে চরম দারিদ্রের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পুষ্টিকর খাদ্য, পরিস্রুত জলের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সন্তানের শারীরিক বিকাশ। ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চলে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত রোগব্যাধি বাড়ছে। খামখেয়ালি আবহাওয়ায় শস্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলে সমগ্র অঞ্চলটিতে খাদ্যসঙ্কট ঘনীভূত হয়। অসংখ্য পরিবার হয় উপবাস, নয়তো পরিযায়ী জীবন বেছে নেয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের বক্তব্যেও এই ভয়ঙ্কর বাস্তবের সমর্থন মিলেছে। ঠিক এর সূত্র ধরেই আসে শিশুদের বৌদ্ধিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার প্রসঙ্গটি। পরিযায়ী জীবনে সর্বাগ্রে কোপ পড়ে শিশুর পড়াশোনায়। সুন্দরবনের মতো যে সমস্ত জায়গা ঘন ঘন দুর্যোগের কবলে পড়ে, সেখানেও পড়াশোনার স্বাভাবিক ছন্দ বজায় থাকে না। ঘরবাড়ি ভেঙে আশ্রয়শিবিরে দিনযাপন করা শিশু কোনও ক্রমে খাবারটুকু হাতে পেলেও বইখাতা থেকে বঞ্চিতই থাকে। ইতিমধ্যেই জলবায়ু সঙ্কটের কারণে প্রতি বছর বিশ্বে ৩.৮ কোটি শিশুর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা যে অপ্রতিহত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে আগামী দিনে শিক্ষাবঞ্চিতদের সংখ্যা কোন অতল স্পর্শ করবে, ভাবলে আতঙ্ক লাগে।
অথচ, এখনও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুঝবার জন্য যে নীতিগুলি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে গৃহীত হয়েছে, তাতে শিশুদের সমস্যা অগ্রাধিকার পায়নি। বিচ্ছিন্ন ভাবে অসরকারি উদ্যোগে করা প্রকল্পগুলি আশাব্যঞ্জক হলেও তা বহু শিশুর কাছে পৌঁছতে সমর্থ হয়নি। জলবায়ু বিপর্যয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে শিশুদের সুরক্ষিত ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করতে শুধুমাত্র অর্থ বরাদ্দই যথেষ্ট নয়, তাদেরও নীতি নির্মাণের অংশ করে তুলতে হবে। তাদের স্বর শুনতে হবে অবশিষ্ট বিশ্বকে। স্থানীয় সমস্যাগুলির সমাধান করতে পঞ্চায়েত, গ্রামসভা এবং শহরাঞ্চলের স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে শিশুদের প্রতিনিধিত্ব রাখতে হবে। কিন্তু যে ‘বড়’রা এখনও উন্নয়ন বলতে পরিবেশ ধ্বংসকেই ধ্যানজ্ঞান মনে করেন, শিশুদের এই প্রয়োজনের প্রতি তাঁরা শীঘ্রই দৃষ্টিপাত করবেন, এমনটি দুরাশামাত্র। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরাট ট্র্যাজেডি এইখানেই।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)