E-Paper

উত্তরের অভিমুখ

রাষ্ট্রপুঞ্জের সেক্রেটারি-জেনারেল অন্তোনিয়ো গুতেরেস মূল কথাটি বলে দিয়েছেন— এই পৃথিবীর আজ আর ভারত-পাকিস্তানের সামরিক সংঘাত নেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই!

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০২৫ ০৬:৩৭

পহেলগাম সন্ত্রাসবাদী হানা কি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাসে আর একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সূচনাবিন্দু, ষাট বছর আগের ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’-এর মতো? না কি সম্প্রতি কালের দুই দেশের বেশ কিছু ‘স্ট্রাইক’ ও ‘অপারেশন’-এর মতো ‘অপারেশন সিন্দূর’ও শেষ অবধি একটি সীমিত সামরিক অভিযান? এই মুহূর্তে প্রশ্নটির উত্তরসন্ধানে ব্যস্ত গোটা উপমহাদেশ, তৎসূত্রে সমগ্র বিশ্বদুনিয়া। ষাট বছরে পৃথিবী আমূল পাল্টে গিয়েছে, বিশ্বমঞ্চে বহু ওলোটপালট এসেছে, ভারত ও পাকিস্তান এখন দুই পুরোদস্তুর পরমাণু শক্তিধর দেশ। এই পরিবর্তিত বিশ্বমঞ্চে দুই দেশ সত্যিই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলে কী ভয়াল দুর্দৈব নেমে আসতে পারে বিশ্বের জনবহুলতম মহাদেশটির উপর— তা মনে করিয়ে দিয়ে আত্মসংবরণের অনুরোধ আসছে চতুর্দিক থেকে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সেক্রেটারি-জেনারেল অন্তোনিয়ো গুতেরেস মূল কথাটি বলে দিয়েছেন— এই পৃথিবীর আজ আর ভারত-পাকিস্তানের সামরিক সংঘাত নেওয়ার মতো ক্ষমতা নেই!

দিল্লির প্রতিরক্ষা মন্ত্রক উবাচ, ৬ মে ভারত-পাক সীমান্তে নয়টি জায়গায় হামলা চালানো হয়েছে, প্রতিটিই সন্ত্রাস-ঘাঁটি। কোনও সেনাঘাঁটি কিংবা অসামরিক লক্ষ্যবস্তু আক্রান্ত হয়নি। এই ঘোষণার মধ্যে হয়তো একটি আশ্বাস খুঁজতে পারেন আশাবাদী নাগরিক যে, তা হলে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের বাইরে আঘাত হানা হবে না। তবে কি না, আশ্বাস ছাপিয়ে আশঙ্কার পারদ এখন ঊর্ধ্বগামী। পাকিস্তান ইতিমধ্যেই প্রতিক্রিয়ার হুমকি দিয়েছে। মূল সমস্যাটি এখানেই। কোনও রাষ্ট্রই হয়তো যুদ্ধের জন্য মুখিয়ে নেই, যুদ্ধের মূল্য দিতে হয়তো কোনও পক্ষই প্রস্তুত নয়, তবু দেশাভ্যন্তরে নিজেদের যুযুধান সমাজকে সন্তুষ্ট করতে দুই রাষ্ট্রই একের পর এক আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়ে ফেলতে পারে। এবং সেই আগ্রাসনের স্বাদে সমাজ আরও প্রতিহিংসাপ্রমত্ত হয়ে পড়তে পারে। এই মুহূর্তে যুদ্ধপ্রস্তুতির বিবিধ ঢালাও বিজ্ঞাপন এবং তার অভিঘাতে সমাজের সহর্ষ উন্মাদনা দেখে সেই আশঙ্কাই প্রবল হয়ে ওঠে। অথচ দেশের শুভবোধসম্পন্ন নাগরিক সমাজের উচিত, যুদ্ধ-যুদ্ধ নিনাদ থেকে বিরত হয়ে সচেতন ভাবে ভাবা যে, যুদ্ধের অর্থটি কী দাঁড়াতে পারে। ভাবা যে, কাকে সেই যুদ্ধের দাম দিতে হবে— অন্যায়কারীকে, না কি অগণিত নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে। নাগরিকেরই এখন রাষ্ট্রকে অনুরোধ করা উচিত— এই সব অত্যুষ্ণ বিনিময় যেন কূটাঙ্গনের সীমা লঙ্ঘন করে সমরাঙ্গণে না পৌঁছয়। জঙ্গি হানা এক বস্তু, কিন্তু রাষ্ট্রের হানা যদি নতুন করে সামরিক বা অসামরিক লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হয়, তাতে বিপদের মহাঘূর্ণিপাক সৃষ্ট হবে। সন্ত্রাস দমনের পথে যুদ্ধের মারণযজ্ঞ শুরু হতে পারে না। বিনাশ দিয়ে বিনাশের উত্তর দিতে গেলে পড়ে থাকে কেবল মুষল পর্ব ও মহাপ্রস্থান পর্ব। সেটাই নিশ্চয় এই উপমহাদেশের অভীষ্ট নয়?

প্রশ্নাতীত ভাবে, বিগত আট দশকের হিংসাবিদীর্ণ রক্তস্নাত কাশ্মীরেও এ বারের পহেলগাম কাণ্ড এক অভূতপূর্ব ঘটনা। পাকিস্তানের মদত থাকুক না থাকুক, তার মাটি থেকে প্রতিবেশী দেশের উপর এমন ভয়াল আক্রমণ ঘটলে তার দায় নিতে সেই দেশ বাধ্য। সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে ইসলামাবাদের দায়িত্ব এবং ব্যর্থতা নিয়ে আগে বহু কথা হয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপেও এত দিন বিশেষ সাফল্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু, এত দিন হয়নি বলেই কখনও হবে না, তেমন মনে করারও কারণ নেই। বাস্তবিক, পহেলগামের পর নানা দেশের, বিশেষত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখে আশা করার হেতু আছে যে সে কাজটিকে এ বার কিছুটা এগোনো যেতেও পারে। ভারতের কাছে এ এক প্রকৃষ্ট সুযোগ। যুদ্ধ লাগিয়ে বিশ্বজনমতকে নিজের বিপক্ষে না ঘুরিয়ে বরং এখনকার পাকিস্তানবিরোধিতাকে কাজে লাগানো উচিত দিল্লির। ‘অপারেশন সিন্দূর’ অবশ্যই ভারতীয় সামরিক শক্তিমত্তার প্রমাণ। এ বার জরুরি, ভারতীয় কূটনীতির দক্ষতা ও কৌশল দেখানো। বিপুল চাপ দিয়ে পাকিস্তানকে ‘নিজের কাজ’টি করতে বাধ্য করা হোক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

India Pakistan Relation Pahalgam Terror Attack

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy