Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
PM Narendra Modi

কোনও প্রশ্ন নয়

যুগ বদলেছে। নিজের গৌরব নিজে জাহির করা এখন নিত্যকর্মপদ্ধতির অন্তর্গত। সমাজের সর্বস্তরেই। বিশেষত রাজনীতির পরিসরে।

An image of Narendra Modi

২০১৪ সালের অভিষেকপর্ব থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং তাঁর সহশিল্পীরা যে ইতিহাস রচনা করেছেন, তা রীতিমতো শ্বাসরোধকর। ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০২৩ ০৫:৪৭
Share: Save:

আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়— ইত্যাকার বাণী এক কালে শিশুদের শেখানো হত। যুগ বদলেছে। নিজের গৌরব নিজে জাহির করা এখন নিত্যকর্মপদ্ধতির অন্তর্গত। সমাজের সর্বস্তরেই। বিশেষত রাজনীতির পরিসরে। রাজনৈতিক দলের নায়কনায়িকা থেকে শুরু করে পাড়ায় পাড়ায় তাঁদের বিঘৎপ্রমাণ শাগরেদবৃন্দ অবধি সকলেই তারস্বরে আপন মহিমা কীর্তনে ব্যগ্র এবং ব্যস্ত। এই প্রবণতা নতুন নয়। কিন্তু এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শ্রেষ্ঠত্বের দাবি জানাতেই পারেন। ২০১৪ সালের অভিষেকপর্ব থেকে তিনি এবং তাঁর সহশিল্পীরা বিরামহীন, বেলাগাম এবং গগনভেদী আত্মপ্রশস্তির যে ইতিহাস রচনা করেছেন, তা রীতিমতো শ্বাসরোধকর। সুতরাং কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের ন’বছর পূর্তিতে এই শাসকরা নিজেদের জমানাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বাঙ্গসুন্দর একটি ‘অচ্ছে দিন’ হিসাবেই প্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন, এতে অবাক হওয়ার কোনও কারণ নেই। বিরোধী দল তথা নিরপেক্ষ সমালোচকরা মোদী সরকারের বিবিধ ব্যর্থতা এবং অন্যায়ের অভিযোগ তুললে শাসকরা সেগুলির সদুত্তর দেওয়ার কোনও চেষ্টাই করবেন না, উল্টে পূর্ববর্তী জমানার বাস্তব এবং কল্পিত নানা ত্রুটি ও অপরাধের নজির তুলে ধরে ‘তার বেলা?’ নামক পাটকেল ছুড়ে চলবেন, এটাই প্রত্যাশিত। ষাট বছরে ভারতের কোনও অগ্রগতিই হয়নি, নরেন্দ্র মোদী ন’বছরে দেশকে জগৎসভায় বরণীয় করে দিয়েছেন— এই প্রচারের সুর ক্রমশই চড়ানো হচ্ছে, ভক্তকুল সঙ্কীর্তনের জন্য দলে দলে প্রস্তুত হচ্ছেন। সরকারের বর্ষপূর্তি প্রকৃতপক্ষে দল, সঙ্ঘ এবং নায়কের কাছে নির্বাচনী প্রস্তুতির একটি উপলক্ষমাত্র।

ইতিহাস বিজয়ীরাই লেখে। দু’ভাবে সেই লেখার কাজ চলে। এক, নিজের সাফল্যকে বাড়িয়ে দেখানো; দুই, নিজের ব্যর্থতাকে আড়াল করা। বর্তমান শাসকদের প্রচারযন্ত্র এই দু’টি কৌশলকেই এক চরম রূপ দিয়েছে। এক দিকে আছে অবান্তর এবং অকিঞ্চিৎকর নানা উদ্যোগ করে সেগুলিকে সাফল্য বলে জাহির করার রীতি। বুলেট ট্রেন বা বন্দে ভারত নামক রকমারি অন্তঃসারশূন্য চমক, ঘরে ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার বসিয়ে দরিদ্র মেয়েদের দৈনন্দিন জীবনে পাশে দাঁড়ানো নিয়ে বাগাড়ম্বর, বছরে দু’কোটি চাকরি দেওয়ার নিষ্ঠুর ‘জুমলা’ পরিবেশন থেকে শুরু করে আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে ‘বারাক’ বলে সম্বোধন বা তাঁকে ‘চা করে’ খাওয়ানো অবধি অগণন দৃষ্টান্ত গত ন’বছরে তৈরি হয়েছে। অন্য দিকে, কোভিড অতিমারির মোকাবিলা থেকে বেকারত্বের বিপুল প্রসার অবধি বহু বিষয়ে রাশি রাশি অপদার্থতা ও অনাচারের সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব থাকা এবং সেই বিষয়ে কোনও প্রশ্নের সদুত্তর না দিয়ে বরং সরকারের প্রতি উত্থাপিত প্রশ্ন বা সমালোচনাকে রাষ্ট্রবিরোধী তথা দেশদ্রোহী আচরণ বলে দাগিয়ে দেওয়ার এক অভূতপূর্ব রীতি এই এক দশকে ক্রমশ প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এই রীতিটির ভিত্তিতে আছে বর্তমান জমানার মূল চরিত্র। নিরঙ্কুশ আধিপত্যের দাবি তার প্রথম এবং প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই দাবিই গত ন’বছরের ইতিহাসে ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে গভীর বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে। শাসককে নিরন্তর প্রশ্ন করার স্বাধীনতা যথার্থ গণতন্ত্রের এক অপরিহার্য শর্ত। অথচ বর্তমান শাসকরা প্রশ্ন করার কোনও সুযোগ দিতেই নারাজ। বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রীকে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রস্তাব বা দাবিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃত অর্থে সাংবাদিক সম্মেলন, যেখানে তাঁকে যে কোনও সঙ্গত প্রশ্ন করার স্বাধীনতা থাকবে। প্রধানমন্ত্রী মোদী আজ অবধি তেমন সুযোগ এক বারও দেননি। দুধের বদলে পিটুলিগোলার স্বাদ একাধিক বার মিলেছে— বেঁধে-দেওয়া প্রশ্নের জবাবে তিনি আত্মপ্রচার করেছেন এবং প্রশ্নকর্তারা হীরক রাজ্যের মন্ত্রীদের ঢঙে ‘ঠিক ঠিক’ বলেছেন। ন’বছর পেরিয়ে দশে পৌঁছেও এই ট্র্যাডিশনই সমানে চলবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

PM Narendra Modi Acche Din BJP Political Slogan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE