E-Paper

ঋণজাল

ব্রিটেন-সহ বহু পশ্চিমি দেশই অভিযোগ করে আসছে, এই ঋণ দেওয়া আসলে চিনের পাতা ফাঁদ, এমন এক জাল যাতে শুধুই জড়ানো যায়, কেটে বেরিয়ে আসা যায় না।

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৫৮
China\'s Debt Trap

সঙ্কটকালে বা শেষ মুহূর্তের পরিত্রাতা হিসাবে চিনের প্রভাব ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে বিশ্বময়। প্রতীকী ছবি।

গল্প-উপন্যাসে দেখা যেত সেই সব জমিদার মহাজনকে, গরিব চাষিকে ঋণজালে জড়িয়ে ক্রমে যারা আত্মসাৎ করত কৃষকের জমি, বাস্তুভিটা, ঘটিবাটিটুকুও। একুশ শতকের চিন যেন ঠিক সেই রকম, অন্তত বিশ্ব অর্থনীতির পর্যবেক্ষকদের মতে। পশ্চিমি কয়েকটি অর্থ-গবেষণা সংস্থার হিসাবমতে, বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিকে ‘উদ্ধার ঋণ’ বা ‘রেসকিউ লোন’ দেওয়ার পরিমাণে বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার, আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে চিন— ২০০৮-২০২১ সময়কালে ২২টি দেশকে দেওয়া ১২৮টি এমন ঋণের মোট পরিমাণ ভারতীয় মুদ্রায় ২৪ হাজার কোটি! ঋণদাতা হিসাবে, বিশেষত সঙ্কটকালে বা শেষ মুহূর্তের পরিত্রাতা হিসাবে চিনের প্রভাব ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে বিশ্বময়।

কোন দেশগুলিকে টাকা ধার দিচ্ছে চিন? প্রধানত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিকে— তার ঋণ-মানচিত্রে রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, সাহারা মরুভূমির দক্ষিণ দিকে অবস্থিত আফ্রিকার দেশগুলি-সহ এক বিরাট অঞ্চলের অনেক দেশ: পাকিস্তান শ্রীলঙ্কা লাওস কিরগিজ়স্তান মঙ্গোলিয়া আর্জেন্টিনা মিশর জ়াম্বিয়া ঘানা ইত্যাদি। জানা যাচ্ছে, চল্লিশেরও বেশি দেশের চিনের কাছে ঋণের পরিমাণ তাদের জিডিপি-র দশ শতাংশেরও বেশি, কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে অন্তত কুড়ি শতাংশেরও বেশি। চিনের সুদের হার আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক বা ফ্রান্স-জার্মানির তুলনায় দুই থেকে চার গুণ পর্যন্ত বেশি, এবং ঋণ শোধ করার সময়সীমাও অনেক কম। স্বাভাবিক ভাবেই নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলি যখন সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে পারে না, চিন তখন আবারও এবং আরও ঋণ দেয়, আগের ঋণ শোধ করার জন্য। দেখা যাচ্ছে এই চক্রটি সদা ঘূর্ণায়মান কিন্তু অপরিবর্তনীয়: ঋণের অর্থে এই দেশগুলির বন্দর, মহাসড়ক, রেল, খনি, টেলিকম-সহ প্রধান ও বড় বড় পরিকাঠামো ক্ষেত্রগুলিতে চিনের প্রকল্প চলছে, এবং দেশগুলি সময়ে ঋণ শোধ করতে না পারায় প্রকল্পগুলির বাণিজ্যিক দখল নিচ্ছে চিন। উদাহরণ বহু, ২০১৭-তে হাম্বানটোটা বন্দর প্রকল্পের ৭০ শতাংশ অংশীদারি চিনা বণিকদের হাতে তুলে দিতে সম্মত তথা বাধ্য হয়েছিল শ্রীলঙ্কা।

ব্রিটেন-সহ বহু পশ্চিমি দেশই অভিযোগ করে আসছে, এই ঋণ দেওয়া আসলে চিনের পাতা ফাঁদ, এমন এক জাল যাতে শুধুই জড়ানো যায়, কেটে বেরিয়ে আসা যায় না। অর্থব্যবস্থা তথা অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ঋণকে চিন করে তুলেছে ভূ-রাজনীতি ও কূটনীতির মহাস্ত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন চিনের ঋণদানের কোনও সরকারি খতিয়ান নেই, প্রক্রিয়াটি অস্বচ্ছ— দুর্নীতি ও সুবিধাবাদে ভরা; নানা দেশে চলা চিনা প্রকল্পগুলিতে শ্রম-অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ভূরি ভূরি, বহু প্রকল্পই পরিবেশবান্ধব নয়। অথচ সেই দেশগুলি এর বিরুদ্ধে রা কাড়তে পারে না, চিনের কাছে নিরন্তর হাত পেতে রাখার কারণে। এ যেন অর্থনীতির জানলা দিয়ে ঢুকে রাজনীতির দরজাটিকে নিজের ইচ্ছামতো খোলা বা বন্ধ করার ক্ষমতাটি আদায় করা, প্রয়োজনে বা সুযোগ পেলে সামরিক পেশিশক্তি দেখাতেও যা বিন্দুমাত্র সময় নেবে না। বণিকের মানদণ্ড রাত পোহালে বহু দেশেই রাজদণ্ড রূপে দেখা দিয়েছিল; চিন এখনও রাজদণ্ডটি হাতে নেয়নি বটে, তবে প্রবণতাটি দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে জাঁকিয়ে বসার।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

China Debt

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy