Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Manipur Violence

ব্যর্থ

মণিপুরের শিশুরা এই মুহূর্তে কী নিয়ে খেলছে, কিংবা আদৌ খেলছে কি না, বড়রা কি খোঁজ রাখছেন তার?

Manipur.

মণিপুরের দশ হাজারেরও বেশি শিশু-কিশোরের দিন কাটছে আশ্রয় ও ত্রাণশিবিরে। ছবি: পিটিআই।

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২৩ ০৫:১৩
Share: Save:

শিশুরা কী ভাবে শেখে? শিশুমনস্তত্ত্ববিদরা বলেন, অনেকটাই অনুকরণে। বড়দের মুখে শুনে শুনে ভাষা, সেই মতো অঙ্গসঞ্চালনা, ক্রমে ভাবভঙ্গি, আচরণ— এ ভাবে শিখতে শিখতে সে বড় হয়। শৈশবে বড়রা হাতে তুলে দেন খেলনা, লিঙ্গপরিচয়সাপেক্ষে আজও তা ছেলেদের ক্ষেত্রে মুখ্যত খেলনা বন্দুক আর গাড়ি, মেয়েদের ক্ষেত্রে পুতুল। কিন্তু মণিপুরের শিশুরা এই মুহূর্তে কী নিয়ে খেলছে, কিংবা আদৌ খেলছে কি না, বড়রা কি খোঁজ রাখছেন তার? তিন মাস ধরে চলা কুকি-মেইতেই সংঘাত পেরিয়ে আজকের মণিপুরের রূঢ় বাস্তব রাজ্য ও রাজ্যের বাইরে কয়েকশো আশ্রয় ও ত্রাণশিবির, এই মুহূর্তে সেখানে দিন কাটছে দশ হাজারেরও বেশি শিশু-কিশোরের। এদের যথাশীঘ্র স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কাজ করে চলেছে কয়েকটি সংগঠন, তাদের সূত্রেই জানা গিয়েছে, এই শিশুরা আর খেলনা চাইছে না। ‘সবচেয়ে প্রিয় কী’-র উত্তরে ক্লাস সিক্সে পড়া একটি ছেলে লিখেছে রাইফেল, ‘বড় হয়ে কী হতে চাও’-এর উত্তরে কেউ বলেনি ডাক্তার বা শিক্ষক হওয়ার কথা। ত্রাণশিবিরে যখন আর চুপ করে বসে সময় কাটছে না, তখন এরা দৌড়ে বেড়াচ্ছে কল্পিত রাইফেল-মেশিনগান হাতে, মুখে ছোটাচ্ছে গুলির ছররা। গত তিন মাস তারা বড়দের যা করতে দেখেছে, তার অনুকরণ!

এই শিশুদের খেলনা নিয়ে খেলতে না চাওয়া খুব অপ্রত্যাশিত কি? চোখের সামনে যে দেখেছে আগুনে নিজেদের বাড়ি পুড়ে যাওয়ার, মা-বাবা ভাইবোন-প্রিয়জনের আহত বা নিহত হওয়ার দৃশ্য, খেলা আর দুষ্টুমির মতো স্বাভাবিক শিশুসুলভ আচরণগুলি কি সে আর কোনও দিন করবে? এক কাপড়ে ঘর ছাড়া যে কিশোর-কিশোরীরা পড়শি মিজ়োরামের আশ্রয় শিবিরেও প্রতি রাত নির্ঘুম কাটাচ্ছে, দু’চোখের পাতা এক হতে না হতেই শিউরে জেগে উঠছে দুঃস্বপ্নে, দিনের বেলা তারাই স্মার্টফোনে মণিপুরের ভিডিয়োগুলি দেখে হাতে তুলে নিতে চাইছে অস্ত্র, স্বপ্ন দেখছে প্রত্যাঘাতের। বড় না হতেই এই শিশুরা বড় হয়ে গেল, বুঝে গেল কুকি আর মেইতেই-এর সংজ্ঞা, জাতিপরিচয় ঘিরে মাথাচাড়া দেওয়া ক্ষমতার হিংস্র রাজনীতির সঙ্গে এই বয়সেই গভীর যোগসাজশ ঘটে গেল তাদের। তারা বুঝে গেল, রাষ্ট্র ও পুলিশ তো বটেই, পরিস্থিতি বুঝে সমাজও মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে তাদের থেকে। মণিপুর এক দিন শান্ত হবে, কিন্তু এই শিশুরা আশ্রয় শিবির থেকে কোথায় ফিরবে— কোন ঘরে, কোন প্রতিবেশীদের মধ্যে, উত্তর অজানা। সমবয়সি কাউকে কি সে বন্ধু ভাবতে পারবে আর কোনও দিনও?

পৃথিবীর ইতিহাসে তো বটেই, ভারতের ইতিহাসেও শিশুদের অকালশৈশবহীনতা নতুন নয়। ১৯৪৭ ও তার সংলগ্ন সময়ে দেশভাগ একটা গোটা প্রজন্মকে বিশ্বাস ও বিশ্বাসভঙ্গের প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৪৭-এর নবজাত ভারতের সঙ্গে ২০২৩-এর ভারতের কোনও তুলনা চলে না; সাম্প্রতিক জাতি-সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে মণিপুরে সরকারের ভূমিকা আগাগোড়া সঙ্কীর্ণ স্বার্থবাদী রাজনীতির পূতিগন্ধময়। আজকের মণিপুরের শিশুরা সেই অ-রাজনীতির মূল্য দিচ্ছে আশ্রয় শিবিরে, নিজেদের শৈশবের মূল্যে, শিক্ষার অধিকার ও মানবাধিকারের মূল্যে। এর মধ্যেই চোরাচালান, পাচার, মাদক ব্যবসায় ডুবে যেতে বসেছে শিশুসুলভ বাকি যা কিছুই। যে চূড়ান্ত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতায় মণিপুর থেকে শৈশব মুছে গেল, তার বিচার কে করবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Manipur Children Imphal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE