দিল্লির রাজপথে কংগ্রেসের ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’। ছবি: পিটিআই।
কিছু একটা ভেঙে গেলে তবেই জোড়ার কথা ওঠে। সে দিক থেকে রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো’ যাত্রার তুল্য কোনও রাজনৈতিক উদ্যোগ অনেক দিন এ দেশে দেখা যায়নি। এ দেশকে আজ বাইরে থেকে যেমনই দেখাক, ভিতর থেকে তা খণ্ড খণ্ড হয়ে গিয়েছে, এবং বড় খণ্ডগুলি ছোট খণ্ডের প্রতি নিয়মিত আক্রমণে লিপ্ত রয়েছে। ভোটের স্বার্থচালিত রাজনীতির বাইরে যে আরও এক রকমের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ভাবা যেতে পারে, তার আশা নতুন করে জাগাতে পেরেছে দেড়শো দিনের এই যাত্রা। সম্প্রতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রবীণ শিক্ষক প্রতাপভানু মেহতা একে এক প্রকারের ‘তীর্থযাত্রা’র সঙ্গে তুলনা করেছেন, যদিও সেই তীর্থভাবনায় হিন্দুত্ব-সংবেদনের জায়গা নেই, বরং ‘মহামানবের সাগরতীরে’ ভারততীর্থের ভাবনাটিই এতে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তামিলনাড়ুর ডিএমকে সাংসদ কানিমোঝি, উত্তরপ্রদেশের বিরোধী নেতা-নেত্রী অখিলেশ, মায়াবতী সকলেই এই যাত্রাকে স্বাগত জানিয়েছেন, সমর্থনও জানিয়েছেন। তাঁরা এই প্রয়াসে পা মেলাবেন কি না, জানা নেই, তাঁরা নিজ নিজ বাধ্যবাধকতায় শৃঙ্খলিত। কিন্তু মোটের উপর বহুবিধ বিজেপি-বিরোধী দলের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি পেলেন রাহুল গান্ধী: ২০২২-এর ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে এটাই বড় কৃতিত্ব। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীরে হেঁটে গেলে ভারতজোড়া সমস্যার কোনও সমাধান হবে না, কিন্তু নিছক রাজনীতিক নয়, জননেতা হিসাবে রাহুল গান্ধী যে একটা কিছু বলতে চাইছেন, রাজনীতির আওতার বাইরে থাকা মানুষও হয়তো তা বুঝতে পারছেন। গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতির পরিসীমা বাড়ানোর জন্য এমন যাত্রা যথেষ্টই উপযোগী, এমনকি জরুরিও। গণতন্ত্র যখন অকালমৃত্যুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন এমন ভাবে তাকে হঠাৎ প্রাণের ঝলক ফিরে পেতে দেখা বিশেষ আশাপ্রদ।
কিন্তু, সমস্যাও বড় মাপের। এই যাত্রা রাহুল গান্ধীর বার্তাটি অনেকখানি পৌঁছে দিতে পারবে এমন যদি ধরেও নেওয়া হয়, তার পরেও নানা প্রশ্ন থেকে যায়। যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি ভাবায়, তা হল: মূল বিষয় কি বার্তাটিই, না কি কে বার্তা দিচ্ছেন সেটাই? এই যাত্রা যদি কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে হয়, তা হলে কেন অন্য নেতাদেরও রাহুল গান্ধীর পাশে যথেষ্ট মাত্রায় দেখা যাচ্ছে না। বাস্তবিক, তেমন ভাবে দেখাই যাচ্ছে না? বিরোধী রাজনীতিকে উদ্দীপিত করতেই যদি এই যাত্রা উদ্দিষ্ট হয়ে থাকে, তা হলে কি এই এককত্বের ছবি ও ভাবনাটি সমস্যাজনক নয়? অথচ সহজেই একে ব্যক্তি থেকে দলের কার্যক্রম, এবং দল থেকে বৃহত্তর সমাজের কার্যক্রমে উন্নীত করা যেত। এক-একটি অঞ্চলে যখন ‘যাত্রা’ পৌঁছচ্ছে, সেখানকার কংগ্রেসের সূত্রে মানুষের আন্দোলনে তাকে পরিণত করা যেতে পারত, সেখানকার মূল সঙ্কটগুলিকে তুলে ধরে রাজনীতির ভাষায় তাকে সর্বসমক্ষে উদ্ভাসিত করা যেত। তার জন্য দরকার ছিল বড় ও ছোট স্তরের সব রকম নেতার অংশগ্রহণ, উৎসাহদান।
আরও বড় একটি কথা আছে। ‘যাত্রা’ তখনই সফল হত যখন যাত্রা-র বাইরের উদ্দেশ্যটির যথেষ্ট প্রচার ও প্রসার ঘটত। এই স্পষ্ট রাজনৈতিক প্রচারের অভাবেই এখনও পর্যন্ত বিষয়টি যেন আধ্যাত্মিক, কিংবা নিদেনপক্ষে দার্শনিক হয়ে আছে— যা দেখে সাধারণ মানুষ মোহিত হতে পারেন, কিন্তু কার্যকর বিকল্প নির্মাণের অনুঘটক বলে আশান্বিত হতে পারেন না। রাহুল গান্ধীকে বুঝতে হবে, রাজনীতি বাদ দিয়ে রাজনীতি করা কঠিন। সার্থক নেতৃত্ব মানুষের ক্ষোভ-উদ্বেগকে রাজনীতিতে মূর্ত করে তুলতে পারে। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব কিন্তু গভীর রাজনৈতিক ক্ষোভকেও শেষ পর্যন্ত বিমূর্ততায় নিক্ষেপ করছে। এবং সেই কারণেই, স্থূলে ভুল হচ্ছে বলেই, বিস্তর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ যাত্রা যেন শেষ বিচারে পথহারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy