যুদ্ধকালই বটে। মৃত্যুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, শ্বাসবায়ু চালু রাখিবার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে প্রথম সারিতে দাঁড়াইয়া নেতৃত্ব দিবার কথা ছিল যাঁহাদের, বহু আবেদন-নিবেদন, নির্দেশ-তিরস্কারের পর শেষ অবধি তাঁহারা জাগিয়া উঠিলেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানাইল, অক্সিজেন সরবরাহকে বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের আওতায় আনা হইতেছে। অর্থাৎ, আন্তঃরাজ্য অক্সিজেন পরিবহণে কোনও প্রকার বাধা দেওয়া যাইবে না। তাহার পূর্বেই অবশ্য দিল্লি হাই কোর্ট নির্দেশ দিয়াছিল, প্রয়োজনে আধাসামরিক বাহিনী নামাইয়াও অক্সিজেন সরবরাহ সুনিশ্চিত করিতে হইবে। ভারত এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন। দেশ জুড়িয়া অক্সিজেনের অভাব প্রকট। কোথাও অক্সিজেন না পাইয়া মৃত্যু হইতেছে কোভিড রোগীর, কোথাও হাসপাতালের অক্সিজেন ফুরাইয়া আসিবার কারণে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হইতেছে রোগীদের। এই সঙ্কটের মধ্যেই নাশিকের এক হাসপাতালে অক্সিজেন লিক হইয়া বেঘোরে প্রাণ হারাইলেন ২২ জন কোভিড রোগী। আবার, শ্বাসবায়ুর হাহাকারের মধ্যেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গয়ালের অমৃতবাণী— অক্সিজেনের বেহিসাবি খরচ চলিবে না। কিছু জায়গায় অক্সিজেনের ‘অপচয়’ হইতেছে। অতএব, নাগরিক বুঝিলেন, কম করিয়া শ্বাস লইতে হইবে! এই সঙ্কটের প্রধানতম কারণ পরিকল্পনার অভাব। কেন্দ্রের কর্তারা বারে বারেই আশ্বস্ত করিয়াছেন যে, ভারতে যত অক্সিজেন উৎপন্ন হয়, তাহার তুলনায় চিকিৎসার প্রয়োজনে অক্সিজেনের ব্যবহার অনেক কম— ফলে, শঙ্কিত হইবার কারণ নাই। কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যান্য আশ্বাসের ন্যায় এই ক্ষেত্রেও অর্ধসত্য ও অবিবেচনার ভয়ঙ্কর মিশেল বর্তমান। প্রথমত, দেশে যত অক্সিজেন উৎপন্ন হয়, তাহার একটি বড় অংশ যায় শিল্পের প্রয়োজন মিটাইতে। এমনকি, এই মহাসঙ্কটের মুহূর্তেও শিল্পক্ষেত্রে অক্সিজেন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা হইতে নয়টি ক্ষেত্রকে ছাড় দেওয়া হইয়াছে, কারণ অক্সিজেন বন্ধ হইলে সেই শিল্পও স্তব্ধ হইয়া যাইবে। দ্বিতীয়ত, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে চিকিৎসা-প্রয়োজনে অক্সিজেনের চাহিদা, আর কোভিড-এর ঢেউয়ের শীর্ষে সেই চাহিদা যে এক হইতে পারে না, তাহা বুঝিবার মতো বিবেচনা দেশের শীর্ষ নেতাদের থাকা প্রয়োজন। প্রতি দিন কোভিড রোগীর সংখ্যা বিপুল হারে বাড়িতেছে— ফলে অক্সিজেনের চাহিদাও বাড়িতেছে। কর্তারা এই হিসাবটিও কষেন নাই? কষিলে, ২০২০’র এপ্রিল হইতে ২০২১’এর জানুয়ারির মধ্যে অক্সিজেন রফতানি ৭০০ শতাংশের অধিক বাড়িতে দেওয়া হইল কী করিয়া? এহ বাহ্য। কোভিড সংক্রমণের পর নূতন অক্সিজেন উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের যে নির্দেশ মিলিয়াছিল, তাহার টেন্ডার ডাকিতেই সময় কাটিয়া গিয়াছে আট মাস! পাটিগণিতের হিসাব বলিতেছে, দেশে যে পরিমাণ অক্সিজেন মজুত আছে, তাহাতে আর বড় জোর দুই সপ্তাহ চলিতে পারে। সরকার যদি এখনও সর্বশক্তি দিয়া ঝাঁপাইয়া না পড়ে, ভবিষ্যৎ কল্পনার অতীত। এই সময়ে সর্বাগ্রে উচিত ছিল রাজধর্ম পালন। কিন্তু এই জমানায় সেই আশা অলীক। এখনও সমানে বিরোধী রাজ্যগুলির প্রতি বঞ্চনার অভিযোগ উঠিতেছে। যেমন করিয়া হউক অক্সিজেন জোগাড় করিয়া হাসপাতালগুলিতে অবিলম্বে পৌঁছাইতে হইবে, এই কথা বলিতে হাই কোর্টের প্রয়োজন হইতেছে। অর্ধসত্য ও ডাহা মিথ্যার বেসাতি ছাড়িয়া কেন্দ্রীয় সরকার এই পরিস্থিতিকে তাহার প্রাপ্য গুরুত্ব দিক। বিশ্ব বাজার হইতে যে ভাবেই হউক, অক্সিজেন জোগাড় করিয়া আনুক। একের পর এক হাসপাতালে রোগীরা অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসরুদ্ধ হইবেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় নথিভুক্ত হইবে শ্বাস না লইতে পারিবার ভয়ঙ্কর ঘটনাক্রম— এই অবস্থা এক মুহূর্তের জন্যও সহ্য করা চলে না। চাতুর্য ত্যাগ করিয়া নেতারা এই বার নেতৃত্ব দিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy