Advertisement
E-Paper

এসে ভেসে যায়

কুশ শতকের শুরুর দিকেও তপোবন-বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশে হেলাং জনপদ থেকেই হাঁটাপথে উরগম গ্রাম পেরিয়ে প্রায় ৯ কিমি হেঁটে যেতে হত পঞ্চকেদারের শেষ কেদার কল্পেশ্বর।

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৩ ০৬:২৩
অতীতের দিকে তাকালে, ধ্বংসের এই চেহারার পাশাপাশি ধ্বংসের গতিটিও বিশেষ রকম অবাক করতে পারে।

অতীতের দিকে তাকালে, ধ্বংসের এই চেহারার পাশাপাশি ধ্বংসের গতিটিও বিশেষ রকম অবাক করতে পারে। ফাইল ছবি।

কেদারনাথে ২০১৩ সালের হড়পা বানে মন্দাকিনী নদীর ডান দিকে প্রচলিত হাঁটাপথ ও সেখানে রামওয়াড়া চটি তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা এই মুহূর্তে অনেকেরই মনে পড়বে। সে বার টিহরী জলপ্রকল্প, হাঁটাপথে বড়-বড় হোটেল ও লজ নির্মাণের সৌজন্যে রুদ্রপ্রয়াগে মন্দাকিনী নদী ফুঁসে উঠেছিল। টিহরী এলাকায় স্কুল, কলেজ মাটিতে কয়েক ইঞ্চি বসে গিয়েছিল, কেদারের হাঁটাপথ যেখানে শুরু হয়, সেই গৌরীকুণ্ড জনপদটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সে বারের সেই শোচনীয় অভিজ্ঞতার পরও সরকার শিক্ষা নেয়নি। ‘উন্নয়ন’ উত্তেজনা অব্যাহত থেকেছে। ভূমিকম্পপ্রবণ জোশীমঠে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, পর্যটনশিল্প থেকে নগদপ্রাপ্তির আশায় চার ধামকে একত্র করার জন্য প্রশস্ত হাইওয়ে ও রেলপথ নির্মাণ-প্রকল্প ধাপে ধাপে বর্ধিত হয়েছে। অথচ, আজ এক বার ফিরে অতীতের দিকে তাকালে, ধ্বংসের এই চেহারার পাশাপাশি ধ্বংসের গতিটিও বিশেষ রকম অবাক করতে পারে। হাজার বছর ধরে পাহাড় ও মানুষের যে সাহচর্য অক্ষুণ্ণ থেকেছে, কত দ্রুত তা ভেঙে চুরমার হওয়ার জোগাড়, দেখলে বিস্ময় যেন বাধ মানে না।

জোশীমঠে শঙ্করাচার্যের গদি: আদি শঙ্করাচার্য ভারতের চার প্রান্তে তাঁর তৈরি চার মঠ পরিচালনার জন্য এক জন করে শিষ্যকে দায়িত্ব দেন। জোশীমঠের দায়িত্ব পান গাছগাছড়া, ঔষধি বিষয়ে পণ্ডিত তোটকাচার্য। এই সব পুরাকথাই বলে দেয়, পুরী বা দ্বারকার তুলনায় জোশীমঠের উদ্ভিজ্জ-প্রকৃতি কত মূল্যবান। আধুনিক গাড়োয়ালের লিখিত ইতিহাসও জোশীমঠের এই প্রাকৃতিক সম্পদের কথা জানে। মানা ও নীতি, দুই গিরিপথ বেয়েই তৎকালীন তিব্বত (অধুনা চিন) ও গাড়োয়ালের মানুষরা যাতায়াত, ব্যবসাবাণিজ্য করতেন। আজকে জোশীমঠ বিপন্ন হওয়ার সঙ্গে কত শত, কিংবা কত হাজার বছরের প্রকৃতি-মানুষ সম্পর্কটি ধ্বস্ত হতে বসল, উন্নয়নবাদীরা জানেন কি? সাধারণত এই ধরনের ঘটনাকে প্রকৃতির প্রতি মানুষের অপরাধ বলে মনে করা হয়। কিন্তু সেটাই সব নয়। এমন ঘটনা আসলে মানুষের প্রতি, মানবসভ্যতার ইতিহাসের প্রতি সংঘটিত অপরাধও বটে।

তবে কি প্রশস্ত রাস্তা, রেলপথের উন্নয়ন হবে না? নিশ্চয় হবে, কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। একুশ শতকের শুরুর দিকেও তপোবন-বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পাশে হেলাং জনপদ থেকেই হাঁটাপথে উরগম গ্রাম পেরিয়ে প্রায় ৯ কিমি হেঁটে যেতে হত পঞ্চকেদারের শেষ কেদার কল্পেশ্বর। তাতে বিশেষ অসুবিধা হত না। চার ধাম সংযোগকারী প্রকল্পের জন্য সেখানে প্রশস্ত রাস্তা, দ্রুত গতিতে গাড়ি ছোটানো এতটাই জরুরি ছিল কি? একে কি সত্যিই ‘উন্নয়ন’ বলে? উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখে গিয়েছেন, সেখানে যেতে গিয়ে প্রথম বার দড়িদড়ার সেতু দিয়ে পার হয়েছিলেন। পরের বার লোহা ও কাঠের সেতু। আর এখন? গাড়ি ছোটানোর পথ করতে গিয়ে পাহাড়টিই আর থাকছে না। প্রকৃতিকে মান্যতা দিয়ে কোথায় কাঠের সেতুতে থেমে যেতে হবে, আর কোথায় রেল-সংযোগ আর প্রশস্ত এক্সপ্রেসওয়ে গড়তে হবে, সেই বুদ্ধিটুকু কি মানুষেরই থাকার কথা নয়? ‘উন্নয়ন’ বস্তুটি আজকের কথা নয়, আদিম মানুষ যে দিন আগুন জ্বালাতে শেখে, সে দিন থেকেই মানুষ প্রকৃতি-ধ্বংসের উন্নয়নে রত হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতির উপর আক্রমণ করতে-করতে এই ভয়ানক আত্মঘাত— এ কেবল উন্মার্গগামী আধুনিক মানুষের পক্ষেই সম্ভব। মানুষ কবে বুঝবে যে, প্রকৃতিকে নিজের বাইরের অস্তিত্ব বলে না দেখে নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয় শর্ত হিসাবে তার দেখা উচিত? মুশকিল হল, ইতিমধ্যে যে প্রকৃতির বিষম ক্ষতিতে মানুষের বিষমতর ক্ষতি নিকটবর্তী, আরও নিকটবর্তী হয়ে আসছে— তার বার্তাগুলি এসে-এসে ভেসে-ভেসে চলে যায়। মানুষ সে বার্তা গ্রহণ করে না।

Joshimath Disaster Kedarnath Natural Disasters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy