Advertisement
২৩ অক্টোবর ২০২৪
Sikkim Flood

শিয়রে বিপদ

কেন বার বার বিধ্বস্ত হচ্ছে পাহাড়, এর উত্তরটি লুকিয়ে আছে সরকারি নানা সিদ্ধান্তের অন্দরে। যেখানকার যেমন ভূপ্রকৃতি, তার বিরুদ্ধে গিয়ে উন্নয়নের প্রচেষ্টা আত্মধ্বংসকারী।

Sikkim

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২৪ ০৮:২২
Share: Save:

গত অক্টোবরে হিমবাহ হ্রদ ফেটে উত্তর সিকিমে ভয়াল বন্যার স্মৃতি এখনও ফিকে হয়নি। তার মধ্যেই সিকিমে সাম্প্রতিক প্রবল বৃষ্টি, ধস ও ফুঁসতে থাকা তিস্তা ফের সেই বিপর্যয়ের দিনগুলি ফিরিয়ে দিল। অক্টোবর এবং জুন— তীব্রতা ও ব্যাপ্তির দিক থেকে দু’টি বিপর্যয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও ঘটনাপরম্পরা প্রায় একই। প্রবল বৃষ্টিতে উত্তরবঙ্গ থেকে সিকিম পৌঁছনোর গুরুত্বপূর্ণ ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক বন্ধ, উত্তর সিকিমে প্রবল বৃষ্টি ও ধসে ছ’জনের প্রাণহানি, তিস্তার জল বিপদসীমা পার করে কালিম্পঙেরও একাংশ ভাসিয়ে দেওয়া— প্রতি বছর এমনটিই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়াচ্ছে পাহাড়ের। সমতলের অসহনীয় গরমে পর্যটকরা পাহাড়ে স্বস্তি খুঁজতে গিয়েছিলেন। সেই স্বস্তি দুশ্চিন্তায় পর্যবসিত। প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া একাধিক পর্যটনকেন্দ্রকে খানিক স্বাভাবিক করে পর্যটকদের উদ্ধার করাই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সিকিম প্রশাসনের কাছে। উদ্ধারকাজ-অন্তে পর্যটকরা আপাতত বাড়ির পথে, বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে ভেঙে পড়া পরিকাঠামোকেও সুস্থ করার প্রচেষ্টা জারি আছে। কিন্তু প্রশ্নগুলো মিলিয়ে যায়নি— পরিবেশ বনাম উন্নয়নের সংঘাতের প্রশ্ন। উত্তরাখণ্ডের পথ পেরিয়ে আপাতত সেই প্রশ্ন পশ্চিমবঙ্গবাসীর একেবারে শিয়রে এসে পৌঁছেছে।

কেন বার বার বিধ্বস্ত হচ্ছে পাহাড়, এর উত্তরটি লুকিয়ে আছে সরকারি নানা সিদ্ধান্তের অন্দরে। যেখানকার যেমন ভূপ্রকৃতি, তার বিরুদ্ধে গিয়ে উন্নয়নের প্রচেষ্টা আত্মধ্বংসকারী। উত্তরাখণ্ড, হিমাচল থেকে সিকিম বার বার সেই প্রমাণই দিয়ে চলেছে। সিকিমের পাহাড় স্বভাবতই ধসপ্রবণ। সামান্য বর্ষাতেই পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে নামে মাটি, পাথরের স্রোত। ভূপ্রকৃতিগত সেই বৈশিষ্ট্যকে অগ্রাহ্য করে সেখানে পাহাড় ফাটিয়ে তৈরি হচ্ছে সেবক-রংপো রেলপথ। যে উত্তর সিকিম বার বার প্রকৃতির রোষে পড়ছে, সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্বিচারে গাছ, পাহাড় কেটে চওড়া হয়েছে রাস্তা, গড়ে উঠেছে অগুনতি হোটেল। সেখানে পাহাড়ি নদীর দু’পাশের প্লাবনভূমি প্রায় চোখেই পড়ে না। নদীখাতের উপরে হুমড়ি খেয়ে গড়ে উঠেছে হোটেল, রেস্তরাঁ। অতিবৃষ্টিতে নদীর জল বৃদ্ধি পেলে বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার কারণটি তাই সহজবোধ্য। এই সমস্ত নির্মাণের পূর্বে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে বিপদের সম্ভাবনাগুলি খতিয়ে দেখা হয় কি না, সন্দেহ আছে।

উষ্ণায়নের প্রভাবে বিশ্ব জুড়ে আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাবটি ইতিমধ্যেই স্পষ্ট। তার থেকে পাহাড়ও যে রেহাই পাবে না, তা নিশ্চিত। কিন্তু প্রাকৃতিক সেই পরিবর্তনকে আরও উস্কে দিতে পারে, এমন বিবেচনাহীন কর্মকাণ্ডের খুব কি প্রয়োজন আছে? বহু বার বিশেষজ্ঞরা তিস্তা নদীর খাত পাথর, পলিতে ভরাট হয়ে আসার কথা বললেও আশ্চর্যজনক ভাবে সরকারের কাজ এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র একের পর এক বাঁধ নির্মাণেই আবদ্ধ। পাহাড়ের উন্নয়ন প্রয়োজন অবশ্যই, কিন্তু সেই উন্নয়নের বিপুল ভার সামলানোর জমিটি যথেষ্ট শক্তপোক্ত কি না, সেটা দেখে নেওয়াও একই রকম জরুরি। গুরুত্ব দিতে হবে জঙ্গল কাটায়, বাঁধ নির্মাণে স্থানীয়দের আপত্তিকে, কারণ ভূমিপুত্র হওয়ায় তাঁরাই সেখানকার মাটিকে চেনেন নির্ভুল ভাবে। দুর্ভাগ্য, রাজ্য, কেন্দ্র উভয় সরকারই এ বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত উদাসীন। সুতরাং, এই ধ্বংস, প্রাণহানি ঠেকানোর উপায়টিও আপাতত তিস্তাগর্ভেই বিলীন হয়ে গিয়েছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Sikkim Flood landslides Environment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE