E-Paper

প্রতিশ্রুতির বন্যা

সব প্রতিশ্রুতি অবশ্য মানুষ ভোলে না। বিশেষত যে সব ক্ষেত্রে মানুষের হাতে সরাসরি টাকা তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, জনগণ সেগুলির কথা মনে রাখে বিলক্ষণ।

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২৩ ০৬:০১
PM Narendra Modi.

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

যতই ‘রেউড়ি রাজনীতি’ বলুন, নির্বাচনী সভায় গিয়ে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও পিছপা নন। কর্নাটকে মেলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি, রাজস্থানেও তা-ই। এমনকি ঝাড়খণ্ডে বিরসা মুন্ডার গ্রামে গিয়েও জনজাতি উন্নয়নকল্পে বিস্তর বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সব দলকেই খয়রাতির রাজনীতি করতে হয় কেন, তার অর্থনৈতিক কারণ নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছে। যে কথাটি তুলনায় কম আলোচিত, তা হল খয়রাতির রাজনীতি প্রকৃত প্রস্তাবে সবচেয়ে কম ব্যয়বহুল রাজনৈতিক অস্ত্র। যিনি যা-ই বলুন, খয়রাতির রাজনীতি প্রকৃতার্থে স্বপ্নে রাঁধা পোলাও— তাতে ঘি ঢালতে কার্পণ্য করার কারণমাত্র নেই। কোনও দলেরই নেই। জনস্মৃতি স্বভাবতই ক্ষীণ। ফলে, রাজনীতিকরা আশা করতেই পারেন, নির্বাচনের আগে জনজাতি কল্যাণ খাতে ২৪,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করার কথা ঘোষণা করলেও ভোটের ফল বেরোনোর পরে বিশেষ কেউ সে কথা মনে রাখবেন না। এ-হেন আশার সপক্ষে ভারতীয় গণতন্ত্র যথেষ্ট কারণ পেশ করেছে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী যে সব অর্থনৈতিক বা কল্যাণমুখী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার ক’আনা বাস্তবায়িত হয়েছে, সেই হিসাব বিশেষ কেউ দাবি করেছেন কি? এমনকি, সবার অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিকে অমিত শাহ ‘জুমলা’ অর্থাৎ ‘কথার কথা’ হিসাবে চিহ্নিত করে দেওয়ার পরও কি কেউ প্রশ্ন করেছেন, ভোটে জেতার জন্য জেনে-বুঝে এমন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল কেন? জনগণের ক্ষমাশীলতার উপর রাজনীতিকদের আস্থাই কি তাঁদের মুখে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ফোটায়?

সব প্রতিশ্রুতি অবশ্য মানুষ ভোলে না। বিশেষত যে সব ক্ষেত্রে মানুষের হাতে সরাসরি টাকা তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, জনগণ সেগুলির কথা মনে রাখে বিলক্ষণ। নেতারাও মনে রাখেন। কারণ, নেতারাও জানেন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোয় উন্নতি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থানের পরিধি বিস্তার অথবা সামাজিক বৈষম্যহীন উন্নয়নের সুযোগ ইত্যাদির ব্যবস্থা করার চেয়ে অনেক সহজ মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়া। রাজস্থানে যেমন কংগ্রেস ও বিজেপি প্রতিযোগিতামূলক খয়রাতির পথে হেঁটেছে— মহিলাদের হাতে নগদ টাকা, ছাত্রদের জন্য ট্যাবলেট, বেকার ভাতা, প্রতিটি প্রতিশ্রুতিই বলছে যে, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের কথা না ভেবে নগদ নারায়ণের উপরে ভরসা রাখাকেই দলগুলি শ্রেয় বিবেচনা করে। কৃষকদের জন্য সহায়ক মূল্য বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ মাসুলে ছাড় বা ঋণ মকুবের মতো প্রতিশ্রুতি হাওয়ায় ভাসছে। সেগুলি কতখানি রক্ষিত হবে সে প্রশ্ন ভিন্ন, কিন্তু নেতারাও জানেন যে, কৃষি পরিকাঠামোর উন্নতি বা কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগের মতো প্রতিশ্রুতিতে ভোটের চিঁড়ে ভেজে না। যে খয়রাতি শেষ অবধি দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির পক্ষে সহায়ক হয় না, ভারতীয় রাজনীতি শেষ অবধি তার নাগপাশেই আটকে পড়ল— কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, এর দায় কার? নেতাদের, না কি জনগণের, যারা নিজেদেরই দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে অবহেলা করে বর্তমানের যৎকিঞ্চিৎ লাভের আশায়? অবশ্য কেউ বলতে পারেন যে, সাধারণ মানুষ রাজনীতির চরিত্রকে বিলক্ষণ বোঝে— বড় উন্নয়নের ‘জুমলা’য় তারা বহু বার ভুলেছে, ফলে হাতেগরম প্রাপ্তি ছেড়ে কেউ আর সেই মরীচিকার পিছনে ছুটতে রাজি নয়। অতএব, ভারতীয় রাজনীতি ‘রেউড়ি’র ঘাটেই জল খায়, বার বার।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

PM Narendra Modi Freebies

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy