E-Paper

ব্যর্থতার ছবি

পশ্চিমবঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক ও শ্রেণিগত বৈষম্যের ছবিটিও স্পষ্ট হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকার নাবালিকা বিবাহ প্রতিরোধে যে উদ্যোগ করেছে, ভারতে তার তুলনা খুব বেশি নেই।

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১০:১০
child marriages

—প্রতীকী ছবি।

এই বছর কোচবিহার ও মুর্শিদাবাদে দুই নাবালিকা মা সদ্যোজাত সন্তান নিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসলেন। এঁদের ‘বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত’ বলে দাবি করা অসম্ভব। এঁরা পশ্চিমবঙ্গে কিশোরীদের একটি বড় অংশের প্রতিনিধি। পশ্চিমবঙ্গ বাল্যবিবাহ কমাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকা ল্যানসেট-এ প্রকাশিত সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্রে দেখা গিয়েছে, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী প্রকল্প চালু থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিবাহের সংখ্যা বেড়েছে। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার (২০১৯-২১) তথ্য— পশ্চিমবঙ্গে আঠারো বছর বয়সে একচল্লিশ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, যা জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০, এই পাঁচ বছরে বাল্যবিবাহ বেড়েছে দশটি জেলায়। সাতটি জেলায় ১৫-১৯ বছরের মেয়েদের গর্ভধারণের হার বেড়েছে। প্রায় দু’শো বছর আগে রেনেসাঁস-আলোকিত বাংলার সমাজ বাল্যবিবাহকে ভারতীয় সমাজের এক কদাচার বলে চিহ্নিত করেছিল। উনিশ ও বিশ শতকে সমাজ সংস্কারের নানা উদ্যোগের কেন্দ্রে ছিল বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ এবং স্ত্রীশিক্ষা। এ বিষয়ে তখন বাংলাই ছিল অগ্রণী। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী পেরিয়ে দেখা যাচ্ছে, সবার পিছনে বাংলা। এর দায় কেবল রাজ্য সরকারের উপর চাপালেই চলে না। আজ যে শিক্ষার থেকে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত পরিবারের কিশোরীদের বিচ্ছিন্নতা ক্রমশ বাড়ছে, তার অন্যতম কারণ, সমাজের ধীশক্তির সঙ্গে জনশিক্ষা ও জনকল্যাণের বিচ্ছিন্নতা। শিক্ষার প্রসারের চাইতে দামি বেসরকারি স্কুল তৈরিতে বেশি উৎসাহী সমাজের কৃতীরা। শিক্ষার অধিকার আইন (২০০৯) সেই বৈষম্য-প্রবণতার উপরে একটি প্রলেপ মাত্র।

পাশাপাশি, পশ্চিমবঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক ও শ্রেণিগত বৈষম্যের ছবিটিও স্পষ্ট হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকার নাবালিকা বিবাহ প্রতিরোধে যে উদ্যোগ করেছে, ভারতে তার তুলনা খুব বেশি নেই। কন্যাশ্রী প্রকল্পে ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আট হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। ২০১৮ সালে ‘রূপশ্রী’ প্রকল্প বছরে পনেরশো কোটি টাকার বরাদ্দ নিয়ে শুরু হয়েছিল। অথচ, এই প্রকল্পগুলি ফলপ্রসূ হল না। তার কারণ এগুলির নির্মাণের মূল ধারণাটি ছিল এই যে, দারিদ্রই স্কুলছুটের কারণ। কন্যার পরিবারকে বাড়তি টাকা, খাবার ও সামগ্রী দিলে পরিবার তাকে দ্রুত বিয়ে দেবে না। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, পূর্ব মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি, কলকাতার মতো অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ জেলাগুলিতে বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে, পুরুলিয়া, উত্তর দিনাজপুরের মতো দরিদ্র জেলায় কমেছে। অর্থাৎ, মেয়েদের দেহ-মনের উপরে নিয়ন্ত্রণ জারি রাখার ইচ্ছা আজও মেয়েদের ভাগ্য নির্ধারণ করছে। তার প্রকাশ কখনও কিশোরীর অনিচ্ছায় তার বিয়ে দেওয়াতে, কখনও পছন্দের সঙ্গীকে পেতে কিশোরীর পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করায়। কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্প নাবালিকা বিবাহ কমাতে না পারলেও, তার মৌলিক কারণগুলিকে উন্মোচিত করেছে। বহু ব্যয়ে এই শিক্ষাটুকু মিলেছে।

নাবালিকা বিবাহের হার নিয়ে প্রশ্ন তুললেই তাকে ‘রাজনৈতিক বিরোধিতা’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার অভ্যাস ছাড়তে হবে শাসক দলকে। অপচয়ী প্রকল্পের নকশায় পরিবর্তন, অথবা নতুন সমাধানের কথা ভাবতে হবে। একই সঙ্গে, সরকারি স্কুলের শিক্ষাকে ছাত্রছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয়, অর্থপূর্ণ করার কাজে সর্বশক্তিতে নিযুক্ত হতে হবে সমাজকে। জাতীয় সমীক্ষা অনুসারে, ৬-১৭ বছরের স্কুলছুট ছেলেদের মধ্যে ছত্রিশ শতাংশ, এবং স্কুলছুট মেয়েদের মধ্যে আটাশ শতাংশ জানিয়েছে, তারা লেখাপড়া ছাড়ছে আগ্রহের অভাবে। প্রায় সমসংখ্যক ছেলেমেয়ে কোনও কারণ জানাতে পারেনি। দারিদ্রকে কারণ বলে জানিয়েছে তুলনায় অনেক কম ছেলেমেয়ে। স্কুলশিক্ষা মেয়েদের মধ্যে সমাজ-অর্থনীতির অংশীদার হয়ে তোলার ইচ্ছা জাগিয়ে তুললে তবেই এর থেকে বেরোনো সম্ভব।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

West Bengal Marriage

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy