বিশ্ব ভূরাজনীতির অস্থিরতার মাঝে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি-র আকস্মিক প্রয়াণে স্তব্ধ গোটা বিশ্ব। গত রবিবার চপার দুর্ঘটনায় বিদেশমন্ত্রী হোসেন আমিরাবদোল্লাহিয়ান-সহ মৃত্যু হয় তাঁর। দু’দেশের ঘনিষ্ঠতার ফলে রইসির মৃত্যুতে গত কাল এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করেছে ভারত সরকার। লক্ষণীয়, দুর্ঘটনার কয়েক দিন আগেই দ্বিপাক্ষিক চুক্তির সুবাদে আগামী এক দশকের জন্য ইরানের চাবাহার বন্দর পরিচালনার ভার হাতে পায় দিল্লি। রইসি ভারত সফরে আসবেন দ্রুত, এমনও স্থির ছিল। বাস্তবিক, ইরানের অভ্যন্তরে রইসির দমনমূলক শাসক ইমেজ যেমন সত্য, কূটনৈতিক বিশ্বে তাঁর দক্ষতাও তেমনই সত্য। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ ইরানের সেই কূটনীতি প্রবাহে ভাটার টান আনবে না, এটাই এখন আশা। আশা, ইরানের তখ্তে এ বার যিনিই আসুন না কেন, ভারতের সঙ্গে ইরানের দীর্ঘকালীন মৈত্রীতে তার ফলে ছেদ পড়বে না।
এমনও আশা করা যায় যে, দুই দেশের দিক দিয়েই ভৌগোলিক অবস্থানগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর প্রকল্পটি অব্যাহত থাকবে। বন্দরের প্রস্তুতি এবং পরিকাঠামোগত উন্নয়নের খাতিরে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করতে চলেছে দিল্লি, তার নিজেরই ভূরাজনৈতিক স্বার্থে— এক দিকে আঞ্চলিক পরিকাঠামো উন্নয়নে পাকিস্তান-চিনের যৌথ সহযোগিতা, এবং অন্য দিকে ওমান উপসাগর অঞ্চলে চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে প্রতিহত করতে। এমনিতেই পাকিস্তানে গদর বন্দর গড়ে তুলে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল চিন। তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) প্রকল্পের অন্তর্গত ‘চায়না পাকিস্তান ইকনমিক করিডর’-এর মতো বাণিজ্যপথ সংক্রান্ত পরিকাঠামোগত প্রকল্পে এযাবৎ বেজিং কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। অন্য দিকে, পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে ভারতীয় বাণিজ্যে এত কাল বাধা দিয়েছে ইসলামাবাদ। ফলে, ইরান, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়ায় নিরাপদ পরিবহণ পথ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি ভারতের পক্ষেও। এমতাবস্থায় চাবাহার বন্দরটির নিয়ন্ত্রণ হাতে পাওয়ায় পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে ইরান, আফগানিস্তান হয়ে রাশিয়া তো বটেই, প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ অথচ স্থলপরিবেষ্টিত তুর্কমেনিস্তান ও কাজ়াখস্তানের সঙ্গেও বাণিজ্যিক আদানপ্রদানে সক্ষম হবে ভারত। পাশাপাশি, ৭২০০ কিলোমিটার বিস্তৃত ইন্টারন্যাশনাল নর্থ সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডর-এর সঙ্গেও চাবাহার-কে যুক্ত করা যাবে, যাতে ভারত, পশ্চিম এশিয়া, ইউরেশিয়া-র মধ্যে যোগাযোগ সহজতর হবে।
তবে ইরানের সঙ্গে দিল্লির এ-হেন সমঝোতা উষ্মা বাড়িয়েছে আমেরিকার। ইতিমধ্যেই তাদের নিষেধাজ্ঞা-আরোপিত রাষ্ট্রটির সঙ্গে বাণিজ্য করার জেরে ভারতকেও যে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হতে পারে, তেমন ইঙ্গিত মিলেছে। অথচ, ২০১৮ সালে তৎকালীন ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন আমেরিকান প্রশাসন চাবাহার বন্দরকে নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে রেখেছিল আফগানিস্তানের উন্নয়নে ভারতের তৎকালীন যৌথ সহযোগিতার খাতিরে। সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লিকে সেই ছাড় দিতে নারাজ তারা। পূর্বে নিজের বিদেশনীতিতে কৌশলগত স্বাধীনতা দেখিয়েছে ভারত। ভবিষ্যতেও সেই স্বাধীনতা যেন অক্ষুণ্ণ থাকে, দিল্লির ক্ষমতা যে দলের কাছেই যাক না কেন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)