ভয়াবহ বিপর্যয় সিকিমে। —ফাইল চিত্র।
মানবচরিত্রই এমন যে বিপদ যখন অন্যের হয়, তার জন্য সমবেদনা জানানো যায়, কিন্তু আঘাত যেন তত ভিতরে এসে লাগে না বলে বেদনা ততটা ‘সম’তা পায় কি না সন্দেহ। নিজের ঘরে বিপদ এলে তখন বোঝা যায়, আঘাতের প্রকৃত অর্থ। সিকিম পশ্চিমবঙ্গের ঘরের কাছেই আর একটি ঘর, এই রাজ্যবাসী দার্জিলিং আর গ্যাংটকের মধ্যে তফাত করেন না। সিকিমের নদীর হড়পা বান জলপাইগুড়ি জেলাকে ঘোর বিপদে ঠেলে দেয়। তাই সাম্প্রতিক অতীতে হিমালয় অঞ্চল জুড়ে অনেক এমন ঘটনা ঘটলেও সিকিমের বিপর্যয়ের তাৎপর্য অন্য মাত্রার। হড়পা বানে বিস্তীর্ণ এলাকা ধুয়ে যাওয়া, মৃত-নিখোঁজের সারির বিভীষিকা এখনও অব্যাহত। ৪ অক্টোবর উত্তর সিকিমের লোনাক হ্রদের জল উপচে তা ধাক্কা দেয় চুংথাং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জলাধারে, জলের চাপে জলাধারের একাংশ ভেঙে প্রবল গতিতে তা নেমে আসে নীচে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সিকিমের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের একাংশ, প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত রাজধানী গ্যাংটক-সহ রংপো, দিকচু, সিংটাম। এখনও পর্যন্ত প্রকৃতির তাণ্ডবে মৃতের সংখ্যা অনেক, নিখোঁজ বহু। সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে এক সেনাছাউনি। বিভিন্ন জায়গায় আটকে থাকা পর্যটকদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। ১৯৬৮ সালের ভয়াবহ স্মৃতি জেগে উঠছে রাজ্যবাসীর মনে। উৎসবের মরসুম সমাগতপ্রায়— পর্যটনের এই ভরা ঋতুতে এমন মর্মান্তিক বিপর্যয় স্তব্ধ করে দেয়।
লোনাক হ্রদে আচমকা জলোচ্ছ্বাসের পশ্চাতে বিভিন্ন তত্ত্ব উঠে এসেছে। হিমবাহের গলন, প্রবল বৃষ্টি এবং ভূমিকম্প। বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে উচ্চ পার্বত্য এলাকায় হিমবাহের গলন এবং তজ্জনিত কারণে পাহাড়ি নদীতে হড়পা বানের প্রাবল্য বৃদ্ধির কথা ইতিপূর্বে বিজ্ঞানীদের আলোচনায় উঠে এসেছে। ২০২১ সালে হিমবাহজাত হ্রদ লোনাক সম্পর্কেও অনুরূপ সাবধানবাণী শোনা গিয়েছিল। হিমবাহের গলনে জন্ম নেওয়া হ্রদে কোনও কারণে অত্যধিক জল সঞ্চিত হলে বা ভূমিকম্পের কারণে তাতে চিড় ধরলে প্রবল জলরাশি হড়পা বান হয়ে নীচের দিকে নেমে আসে। লোনাক হ্রদের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটি ঘটেছে বলে অনুমান। তা ছাড়া কেন্দ্রীয় ভূমিকম্প নিয়ামক সংস্থা জানাচ্ছে, গত ১৫ দিনে এই হ্রদ এলাকার দেড়শো কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে একাধিক ভূমিকম্প ঘটেছে। সেই ভূমিকম্পগুলিই হ্রদে ফাটল ধরিয়েছে কি না, সেও এক আশঙ্কা। উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না নেপালের সাম্প্রতিক জোরালো ভূমিকম্পের পরোক্ষ প্রভাবও। হিমবাহ গলে সৃষ্ট হওয়া হ্রদে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বা ভূকম্পন কী প্রভাব ফেলতে পারে, উত্তরাখণ্ডের একাধিক বিপর্যয় তার প্রমাণ।
তবে, মনুষ্যসৃষ্ট কারণটিকেও অগ্রাহ্য করার নয়। ২০১৪ সালে রবি চোপড়ার নেতৃত্বে গঠিত ১৭ সদস্যের কমিটি উঁচু পাহাড়ি এলাকায় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্কবার্তা দিয়েছিল। সিকিমের তিস্তার উপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ১৪টি বাঁধ রয়েছে। এই বিষয়ে দিল্লিকে চিঠি দিয়ে বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বভাবতই তাতে কর্ণপাত করা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের উৎকণ্ঠার কারণ, সিকিমের বিপর্যয়ের প্রভাব অচিরেই নেমে আসে সমতলে। প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে জলপাইগুড়ি-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের। সুতরাং, আগামী দিনে এই মাত্রার বিপর্যয় ঠেকাতে স্থায়ী সুচিন্তিত পরিকল্পনার প্রয়োজন। আপৎকালীন, অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। এবং ভাবা প্রয়োজন, পাহাড়ি রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলির পর্যটন বিষয়েও। উত্তর সিকিমে প্রবল বৃষ্টি, ধস, রাস্তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া নতুন নয়। অপ্রতুল পরিকাঠামোযুক্ত অঞ্চলে উদ্ধারকাজও যথেষ্ট কঠিন। সুতরাং, ভ্রমণের সময় এবং সর্বোচ্চ পর্যটকের সংখ্যা বেঁধে দেওয়া অযৌক্তিক নয়। বিপদ কেবল দূরে নয়, ঘরের কাছে এবং ঘরের ভিতরে। নির্বিকার থাকার সময় নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy