E-Paper

একটা ডিমই তো

রাজকোষগত ভাবে তাতে কোনও বাধা ছিল না, নীতিগত ভাবেও নয়— ‘পুষ্টিশ্রী’ বা ‘মিল-সাথী’ গোছের একটা নাম দিয়ে চালু করে দেওয়াই যেত তেমন প্রকল্প।

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২৪ ০৯:০৫

—প্রতীকী ছবি।

এক টুকরো পোনা মাছের দাম এখন কমপক্ষে পঁচিশ টাকা। দু’টুকরো মুরগির মাংস অন্তত ত্রিশ টাকা। স্কুলে যারা প্রতি দিন পাত পেড়ে মিড-ডে মিল খায়, সরকার নাহয় তাদের মাছ-মাংস খাওয়ানোর বিলাসিতার কথা ভাবে না, কিন্তু একখানা ডিমকে তো বিলাসিতা বলা মুশকিল। যেখানে পঞ্চম শ্রেণি অবধি ছাত্রপিছু মিড-ডে মিলের বরাদ্দ ৫ টাকা ৪৫ পয়সা, আর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৮ টাকা ১৭ পয়সা, সেখানে সাত টাকা দামের একখানি ডিমই বা ছাত্রছাত্রীদের পাতে তুলে দেওয়ার উপায় কী? চাল-ডাল-আনাজ-তেল-মশলা-জ্বালানি এবং সহায়কের ভাতার খরচও তো এই টাকা থেকেই আসে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ১০,০০০ টাকা দামের ট্যাব উপহার দিতে ব্যস্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে যদি প্রশ্ন করা হয়, জবাব মিলবে— মিড-ডে মিল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প; তারা টাকা না বাড়ালে রাজ্য সরকার নাচার। কথাটি মিথ্যা নয়— মিড-ডে মিলের টাকা কেন্দ্রীয় সরকারেরই দেওয়ার কথা। কিন্তু, সে টাকা যদি না-আসে, পুষ্টিহীন থোড়-বড়ি-খাড়া খেয়ে চলাই কি শিশুদের ভবিতব্য? যেখানে ‘কেন্দ্রীয় বঞ্চনা’ ঘটছে, তার কোনও ক্ষেত্রেই কি রাজ্য সরকার কোনও পদক্ষেপ করেনি? এক শিক্ষক-নেতা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আবাস যোজনাও কেন্দ্রীয় প্রকল্প। কিন্তু, সে খাতে টাকা না এলে রাজ্য সরকারই তা দেবে বলেছে। আবাস যোজনাই একমাত্র নয়— জাতীয় কর্মসংস্থান যোজনার টাকা কেন্দ্র না দিলে রাজ্যই দিয়ে দেবে বলে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মিড-ডে মিলের ক্ষেত্রেও কি তা করা যেত না?

রাজকোষগত ভাবে তাতে কোনও বাধা ছিল না, নীতিগত ভাবেও নয়— ‘পুষ্টিশ্রী’ বা ‘মিল-সাথী’ গোছের একটা নাম দিয়ে চালু করে দেওয়াই যেত তেমন প্রকল্প। লোকসভা নির্বাচনের আগে কয়েক মাস স্কুলে স্কুলে মাংস খাওয়ানোর ব্যবস্থাও করেছিল রাজ্য সরকার। ভোট মিটেছে, শিশুদের পাতও শূন্য হয়েছে। সবই রাজনীতির তাড়না। দুর্ভাগ্য যে, শিশুর পুষ্টির মতো একটি বিষয়— কোনও সভ্য রাষ্ট্রের কাছে যার চেয়ে গুরুতর বিষয় আর কিছু থাকতে পারে না— তা কখনও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে উঠতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী যখন ছাতি চাপড়ে তাঁর গ্যারান্টি দেন, তখনও কেউ তাঁকে প্রশ্ন করেনি যে, কোন মন্ত্রে সাড়ে পাঁচ টাকায় একটি শিশুকে পেট ভরে এক বেলা পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো যায়; মুখ্যমন্ত্রী যখন রাজ্যের এগিয়ে থাকার কথা বলেন, তখনও কেউ জানতে চায় না যে, শিশুদের অর্ধভুক্ত রেখে ঠিক কোন উন্নয়ন সম্ভব। নেতারা জানেন যে, শিশুদের ভোট নেই— আর যাঁদের আছে, তাঁরা শিশুদের পৌষ্টিক প্রাপ্তি নিয়ে তেমন বিচলিত নন। ফলে রাষ্ট্র ও অভিভাবক, দু’পক্ষই ধরে নিয়েছে যে, মিড-ডে মিল বস্তুটি রাষ্ট্রের তরফে শিশুদের দয়ার দান। ভিক্ষার চাল, কাঁড়া আর আকাঁড়া! শিশুর পুষ্টির অধিকারটি যে সংবিধানসিদ্ধ, সে কথা মনে রাখার দায় কোনও পক্ষেরই নেই।

যেখানে অজস্র স্কুলের ছাদ ভেঙে পড়ছে, একটিও ব্যবহারযোগ্য শৌচাগার নেই; স্কুলে গ্রন্থাগার বা কম্পিউটার ল্যাব দূরের কথা, শ্রেণিকক্ষে যথেষ্ট আলো-পাখাও নেই— সেখানে ছাত্রপ্রতি দশ হাজার টাকা ব্যয় করে ট্যাব দেওয়ার যৌক্তিকতা কী, সে প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তিটি সম্ভবত সরল— আজ না হোক, পরশুর পরের দিন অর্থাৎ ২০২৬ সালের মধ্যে এই ছেলেমেয়েদের নাম ভোটার তালিকায় উঠবে। ঠিক যেমন, আবাস যোজনা বা কর্মসংস্থান প্রকল্পের উপভোক্তাদের নামও ভোটার তালিকায় আছে। ক্লায়েন্টেলিজ়ম-এর যুক্তি এক আশ্চর্য বিনিময় প্রথা— যেখানে রাজনীতিককে দেওয়ার মতো কিছু থাকলে তবেই নাগরিকের পক্ষে কিছু পাওয়া সম্ভব। ভারতের রাজনীতি এখন এই যুক্তিতেই চলে। প্রশ্ন হল, শিশুদের প্রাপ্য পুষ্টির অধিকারটুকু পেতে হলে কি ভোটার তালিকায় নাম ওঠা অবধি অপেক্ষা করতে হবে? তার আগে তাদের জন্য দিনে একটা ডিমের ব্যবস্থা করা যায় না?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Midday Meal West Bengal Central Government

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy