Advertisement
০২ মে ২০২৪
Salman Rushdie

সাহিত্যের খুঁত

জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ প্রভৃতির ভিত্তিতে পক্ষপাত আজকের বিশ্বে কখনওই সহ্য করা চলে না। বরং যে কোনও মানুষের অমর্যাদা অসহনীয়— এমনই নীতি হওয়া উচিত।

An image of Salman Rushdie

সলমন রুশদি। ফাইল ছবি।

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০২৩ ০৬:১১
Share: Save:

সাহিত্য তার সময়ের ফসল, সে ভাবেই অতীতের চরিত্র, কাহিনি, সংলাপকে গ্রহণ করতে হবে, মনে করিয়েছেন সলমন রুশদি। আজকের মূল্যবোধের নিরিখে ধ্রুপদী সাহিত্য, বা জনপ্রিয় বইয়ের উপরে কলম চালানোর বিপক্ষে তিনি জোরালো সওয়াল করেছেন সম্প্রতি, ব্রিটেনের একটি সাহিত্য পুরস্কার বিতরণী সভায়। এক ভিডিয়ো বার্তায় রুশদি বলেছেন, কোনও পাঠকের কাছে কোনও বই আপত্তিকর বলে মনে হলে তিনি তা না-পড়তে পারেন। কিন্তু আজকের পাঠকের কাছে যে অংশগুলি আপত্তিকর হতে পারে, প্রকাশক যদি সেগুলি বেছে বেছে বাদ দেন, তা বস্তুত লেখকের লেখার স্বাধীনতা, এবং পাঠকের পড়ার স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা হয়। প্রকাশকদের এমন প্রচেষ্টার একটি উদাহরণও দিয়েছেন তিনি, জেমস বন্ড। লেখক ইয়ান ফ্লেমিং-সৃষ্ট ব্রিটিশ গোয়েন্দার এই চরিত্রটি চলচ্চিত্রের কল্যাণে সারা বিশ্বে সুপরিচিত হয়ে উঠেছে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে লেখা এই কাহিনিগুলিতে বন্ডের চরিত্রটি সাবেক পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি, সাম্রাজ্যবাদ-নিকষিত অহংবোধ তার মজ্জায়, রুশ, তুর্কি, কৃষ্ণাঙ্গ, সকলেই তার চোখে নিকৃষ্ট। সর্বোপরি সে ‘নায়ক’— পৌরুষের আস্ফালন তার মধ্যে আঠারো আনা। অমন চরিত্র আজ কল্পনা করলে মুগ্ধতার চাইতে হাসি আর বিরক্তি কাজ করে বেশি। এই জন্য জেমস বন্ডের সাম্প্রতিক ছবিগুলোতে এই চরিত্রটি হয়ে উঠেছে অনেক সংবেদনশীল, মানবিক, বহুমাত্রিক। মেয়েদের আনা হয়েছে কর্তৃত্বের ভূমিকায়, কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতাকে দিয়ে জেমস বন্ড চরিত্র করানোর জল্পনাও চলছে। সেই স্বাধীনতা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের রয়েছে। তা বলে ফ্লেমিং-এর পুরনো নভেলগুলির উপর কলম চালিয়েসেগুলিকে ‘দোষমুক্ত’ করার চেষ্টা কি সঙ্গত? তেমনই, ছোটদের জনপ্রিয় লেখক রোয়াল্ড ডাল-এর লেখা থেকে কোনও চরিত্রের বিবরণে ব্যবহৃত ‘মোটা’ কিংবা ‘বিচ্ছিরি দেখতে’ শব্দগুলি সম্পাদনা করে বাদ দেওয়া হয়েছে। রুশদি জোরের সঙ্গে এই প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছেন।

রুশদির কথার মূল যুক্তিটি সমর্থন না করে উপায় নেই। জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ প্রভৃতির ভিত্তিতে পক্ষপাত আজকের বিশ্বে কখনওই সহ্য করা চলে না। বরং যে কোনও মানুষের অমর্যাদা অসহনীয়— এমনই নীতি হওয়া উচিত। তা বলে সাহিত্যিকের প্রতি অসহিষ্ণু হওয়া চলে না। নিজেদের বোধবুদ্ধি অনুসারে গল্প, উপন্যাস থেকে খুঁটে খুঁটে কিছু কথা বাদ দিলে লেখকের স্বাতন্ত্র্যে হস্তক্ষেপ করা হয়। সমসময়ের এবং ভবিষ্যতের পাঠকের সঙ্গেও প্রতারণা করা হয়। কারণ, মূল রচনাটি সমগ্র মানবজাতির উত্তরাধিকার। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের উপদেশে, মহাকাব্যের নায়কদের আচরণে মেলে ভয়ানক অন্যায়ের উদাহরণ। উদ্বেগ জাগতে পারে, পক্ষপাতদুষ্ট কাহিনি কি শিশু-কিশোরদের প্রভাবিত করবে না? তাদের মধ্যে চিরাচরিত বিদ্বেষের বীজ নতুন করে বপন করবে না? রুশদির মত অনুসরণ করলে বলতে হয়, যে বইগুলি শিক্ষক, অভিভাবকরা অনুপযুক্ত বলে মনে করবেন, সেগুলি ছোটদের পাঠ্যতালিকার বাইরে রাখা যেতে পারে। তবে উপায় আরও একটি আছে। তা হল, শিক্ষক বা অভিভাবকরা পড়ুয়াদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন, কোন সময়ে, কী পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হয়েছিল সেই বইগুলি। বিবিধ চরিত্র, বিবিধ সংলাপের কোনটি আপত্তিকর, কেন আপত্তিকর, তার আলোচনা নবীন প্রজন্মের চিন্তার স্বাধীনতাকে পুষ্ট করবে, অপরের সমালোচনার পাশাপাশি আত্মসমালোচনার অভ্যাস তৈরি করবে। গণতন্ত্রে এই হল শিক্ষার প্রধান গুণ। কোনও কথাকে আপত্তিকর বলে মনে হলেই তাকে বাদ দেওয়া, অর্থাৎ ‘সেন্সর’ করার অভ্যাস গণতন্ত্র-বিরোধী।

ইতিহাস দেখায়, বিজয়ীদের লেখা ইতিহাস, দর্শন, কাব্যই রয়ে গিয়েছে, হারিয়েছে পরাজিতের অমূল্য সাহিত্যসম্পদ। আজকের বিশ্বসাহিত্যের সম্ভার অনেকাংশেই নির্ধারণ করেছে হিংস্র, নিপীড়নকারী রাজনীতি, যা রাজপ্রাসাদ, দেবালয় তছনছের পাশাপাশি পুড়িয়ে দিয়েছে গ্রন্থাগার। বিধর্মী, বিজাতীয় মানুষের প্রতি প্রায় সব ভাষার সাহিত্য নিষ্করুণ। আমাদের অতীত কলুষমুক্ত নয়, অতএব সাহিত্যও সব বিদ্বেষ ও পক্ষপাতের জীবাণুশূন্য হয়ে আমাদের হাতে আসবে, এমন আশা করা চলে না। জীবন যেমন, সাহিত্যও তেমন। গ্রহণ করতে হলে তার সবটাই করতে হয়, সজাগ চিত্তে। সমাজে প্রার্থিত পরিবর্তন আনতে চাইলে নতুন যুগের উপযোগী সাহিত্য নির্মাণ করতে হবে। অতীতের লেখার উপর কলম চালানো সভ্যোচিত নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Salman Rushdie Novelist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE