Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Social Media

উদ্দেশ্য ও বিধেয়

সমাজমাধ্যম সংস্থাগুলির জন্য নূতন যে নির্দেশিকা জারি করা হইয়াছে, তাহার প্রকৃত উদ্দেশ্য বিশেষ ভাবে যাচাই করিয়া লওয়া প্রয়োজন।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২১ ০৫:৫৫
Share: Save:

ভারতে ব্যবসা করিতে চাহিলে ভারতের নিয়ম মানিতে হইবে— ইহা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত দাবি। কিন্তু, নিয়ম মানাইবার ছলে সমালোচককে বশ মানিতে বাধ্য করিবার কাজটি নহে। কাজেই, টুইটারের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বৈরথে প্রথমে স্থির করা প্রয়োজন যে, প্রকৃত সমস্যা কোথায়— টুইটার আইন মানিতে নারাজ, না কি তাহারা সরকারের সমালোচনা করিবার পরিসরটিকে বন্ধ করিয়া দেয় নাই বলিয়া সরকারের গাত্রদাহ? এই ক্ষেত্রে যদি কেহ ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের উল্লেখ করিয়া দাবি করেন যে, এই সমাজমাধ্যম পরিসরগুলি সরকারি নির্দেশ মান্য করিতে পারিলে টুইটারেরই বা তাহা করিতে সমস্যা কোথায়— তবে তাহা কুতর্ক হইবে। শুধু ভারতেই নহে, গোটা দুনিয়াতেই ফেসবুক ও টুইটার প্রায়শ পৃথক পথে হাঁটিয়াছে। রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেই হউক বা ফেক নিউজ় নিয়ন্ত্রণে, টুইটারের ভূমিকা বহু ক্ষেত্রেই ফেসবুকের তুলনায় অনেক বেশি রাজনীতি ও সমাজসচেতন হইয়াছে। ভারতেও এই সংস্থাটির অবস্থান বিচার করিবার ক্ষেত্রে এই অতীত ভুলিলে চলিবে না। সুতরাং, কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী যখন অভিযোগ করিলেন যে, টুইটার সচেতন ভাবে ভারতের আইন মান্য না করিবার সিদ্ধান্ত করিয়াছে, তখন সেই অভিযোগটিতে যাহা উচ্চারণ করা হয় নাই, সেই কথাগুলি কান পাতিয়া শুনা প্রয়োজন। বোঝা প্রয়োজন, দেশের আইন মানাইবার আপাত-সাধু উদ্দেশ্যের পশ্চাতে অন্য কোনও অভিসন্ধি লুকাইয়া নাই তো? গণতন্ত্র-চর্মাবৃত স্বৈরশাসনের প্রবণতা নাই তো?

তথ্যপ্রযুক্তি আইনে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলির জন্য যে ‘ইন্টারমিডিয়ারি গাইডলাইনস’ বা মধ্যস্থতাকারী সংস্থার নির্দেশিকা চালু হইয়াছে, তাহার আপাত-উদ্দেশ্য মহৎ— সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করিয়া কেহ যাহাতে ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়াইতে না পারে, তাহা নিশ্চিত করা। কিন্তু, তাহার জন্য ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘনের যে পরিসর তৈরি করা হইয়াছে, তাহা আদৌ প্রয়োজন কি না, সেই প্রশ্ন উঠিতে পারে। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা স্মরণে রাখা যাইতে পারে। এক, এযাবৎ কাল ভারতে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে হিংসা বা বিদ্বেষ ছড়াইবার যত অভিযোগ উঠিয়াছে, তাহার সিংহভাগের সহিত বিজেপির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ আছে। দুই, নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকার ভঙ্গ করিতে ভারতের শাসকদের সাতিশয় আগ্রহ। আধার লইয়া সরকারের অত্যুৎসাহে বারে বারেই সেই কথাটি উঠিয়াছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এই নূতন সংযোজনাতেই সেই প্রবণতা স্পষ্ট। তৃতীয়ত, বিভিন্ন আইন প্রয়োগ করিয়া বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনে বর্তমান সরকার সিদ্ধহস্ত— দেশদ্রোহ আইনের অপব্যবহার বিষয়ে বিগত কিছু দিনে বিপুল আলোচনা তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। কাজেই, সমাজমাধ্যম সংস্থাগুলির জন্য নূতন যে নির্দেশিকা জারি করা হইয়াছে, তাহার প্রকৃত উদ্দেশ্য বিশেষ ভাবে যাচাই করিয়া লওয়া প্রয়োজন।

দেশে আইন থাকিবে, অথচ কোনও একটি সংস্থা তাহা মানিবে না— এই পরিস্থিতি আইনের শাসনের পক্ষে কাম্য নহে। কাজেই, টুইটার যে অবস্থানটি গ্রহণ করিয়াছে, তাহাকে সমর্থন করা চলে না। সেই কারণেই এই নির্দেশিকাটিকে ভাল ভাবে পরীক্ষা করা জরুরি— যদি তাহা সত্যই গ্রহণযোগ্য না হয়, তবে এই নির্দেশিকা বাতিল করা বিধেয়। এই প্রক্রিয়াটি যাহাতে পক্ষপাতহীন ভাবে সংঘটিত হয়, তাহার জন্য বিপুল রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপ প্রয়োজন। প্রশ্নটি যে শুধু সমাজমাধ্যম সংস্থার নহে, তাহা নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্ন, তাহা ভুলিলে চলিবে না। গণতন্ত্রের শ্বাস রোধ করিবার অভ্যাস যাহাদের আছে, বিনা প্রশ্নে তাহাদের বিশ্বাস করা চলে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Social Media
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE