ময়দানে গীতাপাঠের আসরে চিকেন প্যাটি বিক্রি করার ‘অপরাধ’-এ হিন্দুবীরদের একাংশের দ্বারা দুই সংখ্যালঘু হকারের হেনস্থা, তা নিয়ে সমাজমাধ্যমে তোলপাড়, তিন হেনস্থাকারীর গ্রেফতারি এবং জামিন, অতঃপর ‘এত দ্রুত জামিন’ নিয়ে সমাজমাধ্যমে ‘সেটিং’-এর অভিযোগে তোলপাড়— মাত্র কয়েক দিনে অনেকগুলি কুনাট্যের সাক্ষী থাকল বঙ্গীয় রাজনীতির পরিসর। গত দশ বছরে ভারত যে পথে হেঁটেছে, তাতে মাংস বিক্রির অভিযোগে কোনও সংখ্যালঘু ব্যক্তিকে হেনস্থা করার ঘটনায় বিস্মিত হওয়ার বিন্দুমাত্র কারণ নেই— এমনটা তো হয়েই থাকে। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনা আশঙ্কাজনক। সাম্প্রতিক কালে এ রাজ্যে দৃশ্যত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রসার ঘটেছে, বিভিন্ন হিন্দু পার্বণ উপলক্ষে বাজারে মাছ-মাংস বিক্রি বন্ধ করা নিয়ে ইতস্তত দাবিও শোনা গিয়েছে। কিন্তু, মাংস বিক্রি করছেন বলে কাউকে প্রহার করার ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম ঘটল। হিন্দুত্ববাদীরা খুশি হতেই পারেন যে, শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গও ‘ভারত’ হয়ে উঠল। কিন্তু, যাঁরা সেই অসহিষ্ণু সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী ভারতের অংশ হতে ইচ্ছুক নন, ব্রিগেডের ঘটনা তাঁদের বিচলিত করবেই। এমন আচরণের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পুলিশের। দুশ্চিন্তার বিষয়, অন্তত এই ঘটনাটিতে পুলিশ যে ভঙ্গিতে পদক্ষেপ করেছে, তাতে পুলিশ নিজের দায়িত্ব বিষয়ে কতখানি সচেতন, সে প্রশ্ন উড়িয়ে দেওয়ার কোনও উপায় নেই। এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে যত দ্রুত সম্ভব তদন্ত করে আদালতে প্রমাণ পেশ করতে হবে, এবং তাদের কঠোর শাস্তির দাবি করতে হবে— যাতে এই বার্তাটি পৌঁছয় যে, অন্তত পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এমন বর্বরতা চলতে দেওয়া হবে না।
সাংস্কৃতিক বহুত্বের বিরুদ্ধে যারা খড়্গহস্ত, তাদের কাছে ব্যক্তিগত রুচির অধিকারের কথা বলে লাভ নেই। কেউ চিকেন প্যাটি বিক্রি করলেও তা খাওয়া তো বাধ্যতামূলক নয়— ফলে, গীতাপাঠই হোক বা ফুটবল খেলা, যে কোনও পরিসরেই মাংস ভক্ষণ করলে যার ভাবাবেগ আহত হবে, সে না খেলেই ল্যাঠা চুকে যায়, এই কথাটি উগ্র গৈরিক রাজনীতির কারবারিরা কখনও স্বীকার করবেন না। নিজের ভাবাবেগ আহত হলেই যে অন্যের উপরে চড়াও হওয়ার ছাড়পত্র মেলে না, এই কথাটিও নরেন্দ্র মোদীর ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা অবলীলায় ভুলে যেতে পেরেছেন। কিন্তু, বঙ্গের বৃহত্তর জনসমাজের কর্তব্য হল এই কথাগুলি সব সময় মনে রাখা, এবং মনে করিয়ে দিতে থাকা। সেই কাজটি সমাজের, আর প্রকৃত রাজনীতিকে সামাজিক স্তরের ভাবনায় নেতৃত্ব দিতেই হবে। কিন্তু, খাতায়কলমে পশ্চিমবঙ্গে যাঁরা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রধানতম প্রতিপক্ষ, সে দল যখন ধর্মস্থানগুলিকে ঘোষিত ভাবেই নিজেদের প্রচারের ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেওয়ার কথা বলে, তখন আশাবাদী হওয়ার কারণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়।
বঙ্গবাসীকে আরও একটি কথা ভাবাবে বটে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, এ রাজ্যে প্রায় ৯৮ শতাংশ মানুষ আমিষাশী। ফলে, ময়দানে চিকেন প্যাটি যাঁদের ভাবাবেগে আঘাত করেছিল, তাঁদেরও অনেকেই ব্যক্তিগত জীবনে মাছ-মাংস খান বলেই অনুমান করা চলে। তবুও মাংসে তাঁদের ভাবাবেগ আহত হয় কেন? না কি, সাধারণত হয় না, কিন্তু আজকাল হচ্ছে? বিষয়টি বিপজ্জনক— তাঁরা যে ধর্মীয় রাজনীতিকে আজ মোক্ষ জ্ঞান করছেন, সেই রাজনীতি আমিষ-বিরোধী, ফলে নিজেদের সত্তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও তাঁরা দ্বিতীয় বার ভাবছেন না। সর্বাধিপত্যকামী রাজনীতি এমন সমর্পণই দাবি করে। কিন্তু, যে বঙ্গসন্তানরা আজ হিন্দুরাষ্ট্রের খোয়াবে মশগুল, তাঁরা ভেবে দেখতে পারেন, ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’কে সেই হিন্দুরাষ্ট্র তার প্রথম শ্রেণির নাগরিক হিসাবে গণ্য করবে কি? হিন্দুত্বের যুদ্ধ জয় হয়ে গেলে ‘মছলিখোর বাঙালি’ সে রাষ্ট্রের ‘অপর’ হয়ে উঠবে না তো? ধর্মীয় রাজনীতির মোহে অন্ধ হওয়ার আগে এই কথাগুলি ভাবা প্রয়োজন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)