ভারতের শহরগুলিতে কর্মহীনতা ও বেকারত্বের হার গ্রামকেও ছাড়াইতেছে, এই তথ্য বিশেষ উদ্বেগজনক। একটি বে-সরকারি নমুনা সমীক্ষার তথ্য ইঙ্গিত দিয়াছে যে, অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ প্রশমিত হইলেও শহরে কর্মসংস্থানের চিত্রে বিশেষ রদবদল হয় নাই। তুলনায় গ্রামগুলিতে বেকারত্বের হার পূর্বের তুলনায় কমিয়াছে। আন্দাজ করা যাইতে পারে যে, গ্রামের কৃষিকাজে বিধিনিষেধ না থাকিবার জন্য, এবং এই বৎসর ভাল বর্ষা হইবার ফলে, কৃষিক্ষেত্রে যথেষ্ট গ্রামীণ শ্রমিক কাজ পাইয়াছেন। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, দশ শতাংশ বেকারত্বের যে তথ্য সিএমআইই নামক সংস্থার নমুনা সমীক্ষা হইতে মিলিয়াছে, তাহাও শহরের শ্রমিক ও কর্মীদের বিপন্নতার সম্পূর্ণ ছবি নহে। বিশেষজ্ঞরা মনে করাইয়াছেন যে, যাঁহারা আপন ব্যবসায়ের সহিত যুক্ত— কোনও পণ্য উৎপাদন বা বিপণন করেন, পরিষেবা প্রদান করেন— তেমন মানুষদের কোনও সমীক্ষাই ‘কর্মহীন’ বিবেচনা করিবে না। কিন্তু অতিমারিতে তাঁহারা কার্যত রোজগারহীন। স্বনিযুক্তির ন্যায় স্বল্পনিযুক্তিও কর্মহীনতার প্রকৃত ছবিটিকে আড়াল করিয়া দেয়। অতিমারির প্রথম ঢেউয়ে ভারতের শহরগুলিতে ছাব্বিশ শতাংশেরও অধিক শ্রমিক সপ্তাহে ছত্রিশ ঘণ্টার কম কাজ পাইয়াছিলেন। অর্থাৎ, প্রতি চার জনে এক জন যথেষ্ট কাজ পান নাই। পারিশ্রমিকও কমিয়াছে বহু ধরনের কাজে। অর্ধ-বেতন, সিকি-বেতনে নিযুক্তরা ‘কর্মহীন’ বলিয়া গণ্য হন না, কিন্তু তাঁহাদের বিপন্নতাকে হিসাবে রাখিতে হইবে বইকি। এই বিপন্নতার বৃহত্তম শিকার মহিলারা। নানা সমীক্ষায় স্পষ্ট হইয়াছে যে, অতিমারিতে সর্বাধিক কাজ হারাইয়াছেন মহিলারা, কিন্তু পুনর্নিযুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে মহিলাদের অংশ ন্যূনতম।
এই পরিস্থিতিতে মহাত্মা গাঁধী গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের একটি নগর সংস্করণ চালু করিবার, এবং তাহাতে মহিলাদের কর্মনিযুক্তির বিশেষ সুযোগ রাখিবার দাবি উঠিয়াছে। একশত দিনের কাজের প্রকল্পের চাহিদা বাড়িয়াছে গ্রামীণ এলাকায়। জনমতের চাপে কেন্দ্র টাকা বাড়াইয়াছে— গত বৎসর বরাদ্দ এক লক্ষ কোটি টাকা ছাড়াইয়াছিল। কিন্তু শহরের মানুষের কী হইবে? কেরল ২০১০ সালে শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থান যোজনার সূচনা করিয়াছে, এবং পঞ্চাশ শতাংশ কাজ মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট করিয়াছে। ওড়িশা, হিমাচল প্রদেশ এবং ঝাড়খণ্ড, এই তিনটি রাজ্য আপন অর্থে গত বৎসর শহরাঞ্চলে ওই প্রকল্পের কাজ শুরু করিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গ ২০১০ সাল হইতে শহরাঞ্চলে রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প চালু করিয়াছে, গত বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই প্রকল্পে কর্মীদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধির ঘোষণাও করিয়াছেন। তবে তাহাতে শহরে কাজের চাহিদা কতখানি মিটিয়াছে, সেই তথ্য জনসমক্ষে আসে নাই।
সংসদের শ্রম বিষয়ক স্থানীয় কমিটি গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের সমতুল্য কোনও প্রকল্প শহরাঞ্চলগুলিতে চালু করিবার সুপারিশ করিয়াছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার গত বৎসর সেপ্টেম্বরে সংসদে জানাইয়া দিয়াছে যে, তেমন পরিকল্পনা কেন্দ্রের নাই। না-ই থাকিল, কিন্তু অতিমারির উপর্যুপরি ঢেউ আসিতেছে, বাজারের কর্মসৃষ্টির স্বাভাবিক ক্ষমতা কমিতেছে। এই পরিস্থিতিতে শহরে কর্মহীনতা কমিবে কী উপায়ে? কেবল ঋণ দিয়া দরিদ্রের রোজগার নিশ্চিত করা যাইবে না। বিশেষজ্ঞরা নানা পরামর্শ দিয়াছেন। যথা, জরাজীর্ণ সরকারি ভবন ও অন্যান্য পরিকাঠামোর মেরামত ও সৌন্দর্যায়ন করিতে কর্মহীন অদক্ষ ও দক্ষ শ্রমিকদের নিযুক্ত করা যাইতে পারে। কাজের পাশাপাশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা যাইতে পারে। এমন সুপরামর্শের অভাব নাই— অভাব শুনিবার, করিবার ইচ্ছায়। শহরের দরিদ্রকে বহু দিন উপেক্ষা করা হইয়াছে। এখন আর সেই উপায় নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy