নদী বা জলাশয়ের জলের স্বাস্থ্য কেমন, তা নির্ভর করে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বা মাত্রার উপরে। তাতেই নির্ধারিত হয়, সেই জল স্নান বা পানের উপযুক্ত কি না। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের জলশক্তি মন্ত্রক জানাল, দেশের যে রাজ্য বা অঞ্চলগুলি দিয়ে গঙ্গা বয়ে গিয়েছে, সবগুলি অংশেই গঙ্গার জল স্নানের উপযুক্ত। উত্তরাখণ্ড ও বিহারে গঙ্গার দু’টি অংশে ২০১৫ সালের তুলনায় অনেক উন্নত হয়েছে জলের গুণগত মান, উত্তরপ্রদেশের কনৌজ থেকে বারাণসী এবং পশ্চিমবঙ্গে ত্রিবেণী থেকে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত অংশেও দূষণ বেশ কম। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পের অধীনে পাঁচটি রাজ্যে গঙ্গার ৯৭টি নির্বাচিত অঞ্চলে জলের গুণমান পরখ করে জানিয়েছে তথ্য: জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন, ‘বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিম্যান্ড’ ও ‘ফিক্যাল কলিফর্ম’-এর মতো সূচকগুলিতে ঘটেছে লক্ষণীয় উন্নতি।
এই সব েদখেশুনেই মনে হতে পারে, এখনও তা হলে আশা আছে— দেশের দীর্ঘতম ও আপামর ভারতবাসীর কাছে সন্দেহাতীত ভাবে পবিত্রতম নদীটির জলস্বাস্থ্য এখনও অটুট। মনে হতে পারে, কেন্দ্রীয় সরকারের ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’ ও ‘নমামি গঙ্গে’-র মতো প্রকল্পগুলি তা হলে ঠিকঠাক কাজ করছে। পাশাপাশি স্মরণ করা যেতে পারে গঙ্গার জলের গুণমান নিয়ে পরিবেশবিদদের বহু দশকের উদ্বেগ, অতিদূষণের জেরে গঙ্গাস্নানে স্বাস্থ্যের গুরুতর ক্ষতির আশঙ্কায় বিশেষজ্ঞদের চেতাবনি। মনে পড়তে পারে ২০১৯-এর জুনে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদেরই দেওয়া তথ্য: তৎকালীন গঙ্গার ৮৬টি ‘স্পট’-এর মাত্র ৭টির জল ছিল পানের উপযোগী, ১৮টি স্নানের উপযুক্ত এবং সর্বত্র জলে কলিফর্ম ব্যাকটিরিয়ার প্রাবল্য-সহ ‘বিষাক্ততা’র পরিমাণ এতই বেশি যে স্নান করলে শরীরের রীতিমতো ক্ষতি হতে পারে। গঙ্গার জলের এই দূষণের জন্য যে নদী-সংলগ্ন কলকারখানার শিল্পজাত বর্জ্যই বহুলাংশে দায়ী, তা নাগরিকমাত্রেই জানেন, সরকার তো বটেই। তা হলে ২০১৯-এর এই দুর্দশাচিত্রের পরে গত দু’বছরেই এই অভাবনীয় উন্নতির পিছনে কি অতিমারিজনিত লকডাউন ও অন্যান্য বিধিনিষেধই কাজে দিয়েছে? ২০২০ সালে দীর্ঘ লকডাউনে ভারতে সার্বিক পরিবেশ দূষণ লক্ষণীয় ভাবে কমেছিল। কিন্তু মাত্র একটি বছরের নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির জেরে দেশ জুড়ে গঙ্গার জলে এমন উত্তরণ সম্ভব হল যে রাতারাতি তা স্নানযোগ্য হয়ে উঠল, এই চিত্রটিও কি সম্পূূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য?
২০ হাজার কোটি টাকার ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্পে ২০১৮-১৯ সালের মধ্যে গঙ্গাকে পরিষ্কার করা হবে, প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন। তা সম্ভব হয়নি। কোভিড-পরিস্থিতিতে গত দু’বছরে সরকারের জাতীয় অগ্রাধিকার ছিল স্বাস্থ্য-দুর্যোগের মোকাবিলা, গঙ্গার শোধন নয়। তা সত্ত্বেও ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট-এর মাধ্যমে গঙ্গাতীরবর্তী শিল্পগুলির শিল্পজাত বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ, সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টগুলির আধুনিকীকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে যদি গঙ্গার জলদূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তা বাস্তবিকই আশার কথা। তবে এই ভারতে ধর্ম থেকে পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, চলচ্চিত্র সব কিছু নিয়েই রাজনীতি হয়, নদী নিয়ে হওয়াও বিচিত্র নয়। বিশেষত গঙ্গার মতো নদী, যার সঙ্গে ভারতীয়দের বৃহদংশের ধর্মীয় ভাবাবেগ জড়িয়ে। সেই ভাবাবেগকে দোহনের আশঙ্কাও নিতান্ত অমূলক নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy