Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Supreme Court of India

প্রাণের দায়

জনকল্যাণ অনেক পরের কথা, সাধারণ মনুষ্যত্বের সংজ্ঞাও কি এই রাষ্ট্রের অভিধান হইতে হারাইয়া গিয়াছে?

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২১ ০৬:১৫
Share: Save:

ওয়েলফেয়ার স্টেট বা কল্যাণ রাষ্ট্র নামক ধারণাটির বয়স ইতিহাসের মাপকাঠিতে বেশি নহে। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের মহামন্দার সময় হইতে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী কালে অন্তত সত্তরের দশক অবধি মুক্ত দুনিয়ায় কল্যাণ রাষ্ট্রই ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া গণ্য হইত। ক্রমশ তাহার কিছু ক্ষতিকর ফলও ফলে, জনকল্যাণের নামে অর্থনীতির উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং মালিকানার নাগপাশ বহু দেশের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে— ‘সমাজতান্ত্রিক’ মোহে আচ্ছন্ন ভারত ছিল তাহার এক প্রকট নজির। গত কয়েক দশকে অবস্থায় পরিবর্তন ঘটিয়াছে, বাজার অর্থনীতির খোলা হাওয়ায় উন্নয়নের পথে পুরানো বাধাবন্ধগুলি অনেকটাই দূর হইয়াছে। কিন্তু কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণাটি অন্তর্হিত হয় নাই। বিশেষত ভারতের মতো দেশে যেখানে দারিদ্র ও সুযোগবঞ্চনা এখনও বিপুল জনগোষ্ঠীর নিত্যসঙ্গী, সেখানে জনকল্যাণের প্রতি রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ দায়িত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা কঠিন। স্বভাবতই প্রশ্ন থাকিয়া যায়, সেই দায়িত্বের সীমারেখা কোথায় টানা হইবে? জনকল্যাণের স্বার্থে রাষ্ট্র কোন কোন কাজ করিতে দায়বদ্ধ থাকিবে? বিভিন্ন অবস্থান হইতে এই প্রশ্নের বিভিন্ন উত্তর সম্ভব। অন্য ভাবে বলিলে, কল্যাণ রাষ্ট্রের সীমারেখা নির্ধারণ করা সম্ভব।

সুপ্রিম কোর্ট সেই সীমারেখার ন্যূনতম পরিসরটি স্পষ্ট ভাষায় চিহ্নিত করিয়াছে। সারা দেশে ‘কমিউনিটি কিচেন’ অর্থাৎ গণ-পাকশালা খুলিবার সরকারি নীতি প্রণয়নের আর্জি জানাইয়া সমাজকর্মীদের দাখিল করা এক আবেদন সংক্রান্ত শুনানিতে সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি-সহ তিন বিচারকের বেঞ্চ বলিয়াছে: অনাহারে যাহাতে কাহারও মৃত্যু না ঘটে, তাহা নিশ্চিত করা কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। আদালত অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় এই দায়িত্বকে কল্যাণ রাষ্ট্রের অন্যান্য সম্ভাব্য ভূমিকা হইতে স্বতন্ত্র করিয়া দেখাইয়াছে, এমনকি অপুষ্টির প্রশ্নটিকেও স্বতন্ত্র রাখিয়াছে। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম খাদ্যের অভাব যাহাতে কাহারও না হয়, তাহাই কেবল এখানে বিবেচনা করা হইতেছে। অনেকেই, বিশেষত বামপন্থী, সমাজবাদী বা মানবতাবাদীরা প্রশ্ন তুলিতে পারেন, নাগরিকের জীবনধারণের সংজ্ঞাটিকে কেন আরও প্রসারিত করা হইবে না, রাষ্ট্রের দায় কেন কেবলমাত্র নাগরিকদের বাঁচাইয়া বা জিয়াইয়া রাখিবার কর্তব্যেই সীমাবদ্ধ থাকিবে?

সেই প্রশ্ন অযৌক্তিক নহে, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট জীবনধারণের প্রথম প্রশ্নে সীমিত থাকিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করিয়াছে। আদালতের প্রশ্নটি দেখাইয়া দিয়াছে, ভারতের শাসকরা কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্বটুকু পালনেও ব্যর্থ। কেবল ব্যর্থ নহে, অনাগ্রহী। বস্তুত, বিচারপতিদের বক্তব্যে রাষ্ট্র তথা সরকারের এই অনাগ্রহের প্রতি যে তীব্র তিরস্কার রহিয়াছে, তাহা এক দিকে বিচারব্যবস্থার উপর নাগরিকের ভরসা বাড়ায়, অন্য দিকে নির্বাচিত সরকারের সম্পর্কে নৈরাশ্য গভীরতর করিয়া তোলে। কেবলমাত্র বুভুক্ষু মানুষকে খাওয়াইবার আয়োজন করিতে এই শাসকরা স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া ঝাঁপাইয়া পড়েন না, তাঁহাদের এই কাজে বাধ্য করিতে আদালতে মামলা করিতে হয়, আদালত অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিবার পরেও তাঁহাদের গয়ংগচ্ছ ভাব দূর হয় না, ‘তথ্য সংগ্রহ করিতেছি’ বলিয়া তাঁহারা দায় সারিতে চাহেন! এমন শাসকের প্রতি কেবল বিরাগ নহে, বিবমিষাই স্বাভাবিক নহে কি? বস্তুত, জনকল্যাণ অনেক পরের কথা, সাধারণ মনুষ্যত্বের সংজ্ঞাও কি এই রাষ্ট্রের অভিধান হইতে হারাইয়া গিয়াছে? কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা লইয়া অনন্ত আলোচনা চলুক, আগে লোকের প্রাণ বাঁচানো আবশ্যক। স্বাধীনতার ৭৫ বৎসর পূর্তিতে অনাহারে মৃত্যুর পরিসংখ্যান যেন মহামান্য রাষ্ট্রনায়কদের শিরোভূষণ না হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Supreme Court of India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE