E-Paper

ধ্বনিমাত্র সার

বিজেপি শাসিত মণিপুরের অবিশ্বাস্য রকমের ভয়ঙ্কর ঘটনাবলির দায় স্বীকার করা দূরস্থান, তিন মাস ধরে এই বিষয়ে হাজার প্রশ্ন করেও তাঁর মুখ খোলানো যায়নি।

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২৩ ০৫:০১
PM Narendra Modi.

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

দেশের প্রধানমন্ত্রীকে কোনও বিষয়ে মুখ খুলতে বাধ্য করার অভিপ্রায়ে বিরোধী দলগুলিকে একজোট হয়ে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে হয়েছে, এই বিরল নজিরটি সংসদ, অনাস্থা প্রস্তাব এবং বিরোধী দল, কারও পক্ষেই শ্লাঘার কারণ হতে পারে না। আর প্রধানমন্ত্রী? সাধারণ বুদ্ধি বলবে, এমন ঘটনা তাঁর পক্ষে লজ্জার বিষয়। কিন্তু বিজেপি শাসিত মণিপুরের অবিশ্বাস্য রকমের ভয়ঙ্কর ঘটনাবলির দায় স্বীকার করা দূরস্থান, তিন মাস ধরে এই বিষয়ে হাজার প্রশ্ন করেও তাঁর মুখ খোলানো যায়নি, এবং তা নিয়ে তাঁর আচরণে দেখা যায়নি তিলমাত্র লজ্জাবোধ বা অনুতাপের লক্ষণ। অনাস্থা প্রস্তাবের জবাবি ভাষণেই বা পৃথক ফল কেন হবে? কেনই বা তাঁর কথায় স্বাভাবিক সংবেদনশীলতা ও গণতান্ত্রিক দায়বোধের পরিচয় মিলবে? মণিপুর বিষয়ে প্রথম দেড় ঘণ্টা টুঁ শব্দটিও না করে অবশেষে— সময় মেলানোর খেলায় আশ্চর্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে— বিরোধীদের কক্ষত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই বিষয়ে সবাক হয়েছেন বটে, কিন্তু অশান্তি এবং হিংস্রতার সমস্ত দায় কার্যত অতীতের, অর্থাৎ নেহরু ও তাঁর উত্তরসূরিদের উপর চাপিয়ে দিয়ে জানিয়েছেন, বাকি কথা সবই ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উবাচ। অর্থাৎ, চিত্রনাট্য আগেই প্রস্তুত করা হয়েছিল, তিনি সপারিষদ সেই নাটক উপস্থাপিত করেছেন। বিরোধী জোটের প্রতি এবং বিশেষত সংসদে ফিরে আসা রাহুল গান্ধীর প্রতি বিষোদ্গারও স্পষ্টতই এই চিত্রনাট্যের অঙ্গ। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে এসেছেন, মুখ খুলেছেন এবং নির্বাচনী বক্তৃতা দিয়ে ফিরে গিয়েছেন।

বিরোধীরাও নিশ্চয়ই সে কথা জানেন। অনুমান করা যায়, তাঁদের প্রত্যাশাও ছিল নিতান্ত সীমিত। দু’দিনের অনুষ্ঠান শেষ হলে তাঁরা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত মণিপুর নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন, এটাই তাঁদের নৈতিক জয়। এই বিবৃতিটিও কি পূর্বনির্ধারিত? বিরোধীরাও সংসদে একটি চিত্রনাট্যই অনুসরণ করলেন? যদি তা-ই হয়, তবে তাঁদের পরিকল্পনায় কিন্তু একাধিক ফাঁকফোকর প্রকট হয়ে উঠল। প্রথমত, জবাবি ভাষণ শেষ হওয়ার আগে কক্ষত্যাগের যুক্তি কী? প্রধানমন্ত্রী অন্যায় আক্রমণ করছেন— এ যুক্তির কোনও অর্থ নেই, থাকলে অনেক আগেই সভা ছাড়ার কথা ছিল। তিনি দীর্ঘ দেড় ঘণ্টায় মণিপুর নিয়ে কিছু বললেন না কেন, এই প্রশ্ন অবশ্যই সঙ্গত, কিন্তু তার ভিত্তিতে বক্তৃতার মাঝখানে মহানিষ্ক্রমণের কোনও যৌক্তিকতা নেই। এই বিচিত্র অস্থিরচিত্ততা বা ভুল পরিকল্পনার ফলে বিরোধীরা যুগপৎ নিজেদের এবং আইনসভার গুরুত্বকে খর্ব করলেন, সংসদের বাইরে নিত্যদিনের মতো চেনা কথায় এবং চেনা সুরে কলরব করে যে ক্ষতি পূরণ করা যায় না।

দ্বিতীয়ত, যে বিষয়কে কেন্দ্র করে অনাস্থা প্রস্তাব, সেই মণিপুরের সঙ্কট এবং তার প্রেক্ষাপট ও সূচনা থেকে শুরু করে আজ অবধি কেন্দ্রীয় তথা রাজ্যে শাসকদের অপদার্থতা ও অন্যায় সম্পর্কে যথেষ্ট জোরদার সওয়াল বিরোধীরা গড়ে তুলতে পারলেন না। এমনকি রাহুল গান্ধী নিজেও এই ব্যর্থতার শরিক। মণিপুর সফরের সূত্রে প্রাপ্ত আপন অভিজ্ঞতার কথা তিনি জানিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তথ্য-পরিসংখ্যান সহযোগে শাসকদের দোষ এবং ত্রুটিগুলিকে সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরার দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তার জন্য যে পরিশ্রমের প্রয়োজন, বিরোধী শিবিরের ভাঁড়ারে তার বড় রকমের ঘাটতিই প্রকট হয়ে উঠল। হয়তো পরিশ্রমে তাঁদের আগ্রহ কম, তার বদলে ভারতমাতা হত্যার স্লোগান দিয়ে বাজিমাত করার দিকেই নজর বেশি। এমন ধ্বনিতে করতালি সুলভ, কিন্তু কার্যকর প্রতিস্পর্ধা দূর অস্ত্। বস্তুত, অনাস্থা প্রস্তাব সংক্রান্ত সওয়াল-জবাবের সম্পূর্ণ পর্বটি জানিয়ে দিল, যথার্থ আলোচনা ও বিতর্ক নয়, আওয়াজ এবং পাল্টা আওয়াজই এখন রাজনীতিকদের উদ্দেশ্য ও বিধেয়। যথা নির্বাচনী ময়দানে, তথা নবনির্মিত সংসদ ভবনে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

PM Narendra Modi Manipur parliament

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy