উচ্চ প্রাথমিকের বিক্ষোভে এসেছিলেন মা। তাঁকে আটক করার পরে মেয়ে সমেতই গাড়িতে তুলল পুলিশ। বুধবার সল্টলেকে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
কয়েক হাজার শব্দ খরচ করেও যে কথা বলা যায় না, একটি ছবি তা বলে দিতে পারে সুতীব্র ভঙ্গিতে। যেমন বলল গত ২৩ মার্চ ২০২৩ তারিখে এই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ছবিটি। তাতে এক ক্রন্দনরত বালিকাকে দেখা যাচ্ছে, তার মায়ের পাশে। পুলিশ সেই বালিকাকে আটক করে গাড়িতে তুলেছে। মেয়েটি অপরাধী নয়, তার প্রতি পুলিশের কোনও অভিযোগ নেই। তার মা স্কুলশিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত বিক্ষোভে যোগ দিতে এসেছিলেন, মেয়েটি তাঁর সঙ্গে ছিল মাত্র। পুলিশ তাঁদের বিক্ষোভস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে পরে ছেড়ে দিয়েছে। তার আগে অবশ্য নিউ টাউন থানায় বসিয়ে রেখেছে বেশ কয়েক ঘণ্টা। দৃশ্যত অনূর্ধ্ব আট বছর বয়সি মেয়েটি রাজনীতির মারপ্যাঁচ জানে না; বোঝে না যে, ক্ষমতার বিরুদ্ধে আঙুল তুললে পুলিশ সেই আঙুলকে দমন করতে আসবেই। এই ঘটনায় সে শুধু দেখল, অনেক উর্দিধারী লোক এসে জোর করে তাদের তুলে নিয়ে গেল একটা বাসে। আটকে রাখল সেখানে। মেয়েটি দেখল, যাঁকে সে এত দিন তার সমস্ত বিপদের অলঙ্ঘ্য বর্ম হিসাবে চিনেছে, সেই মা কতখানি অসহায়। রাষ্ট্র কাকে বলে, বোঝার আগেই সে জেনে নিল, রাষ্ট্রীয় পেয়াদারা এমনই নির্মম হয়ে থাকে। জীবনে হয়তো প্রথম বার অসহায় বিপন্নতার স্বাদ পেল সেই বালিকা। ‘ট্রমা’ কথাটি ইদানীং বহুব্যবহৃত, ফলে পরিচিত। এই মেয়েটি সে দিন রাতে বাড়ি ফিরল এত প্রবল ট্রমা নিয়ে। পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, কিন্তু এই ট্রমা, ঘটনার এই বিপুল অভিঘাত তাকে কবে ছাড়বে, আপাতত বলা মুশকিল।
যে পুলিশকর্মীরা এই কাজটি করেছেন, নগরপাল কি তাঁদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিয়েছেন? অন্তত তিরস্কার করেছেন কি? এমন প্রশ্ন করলে পুলিশকর্তাদের সম্ভবত হাসি পাবে। সেই হাসি চেপেই তাঁরা পাল্টা প্রশ্ন করবেন, ওইটুকু বাচ্চাকে নিয়ে আন্দোলন করতে এসেছিলেন কেন ভদ্রমহিলা? এই প্রশ্নের একটিই উত্তর হয়— তিনি সন্তানকে নিয়ে এসেছিলেন, অতএব শুধুমাত্র সেটুকু দেখেই বুঝতে হবে যে, সন্তানকে অন্য কোথাও রেখে আসার কোনও উপায় তাঁর ছিল না। একে তাঁর দুর্বলতা হিসাবে দেখা, এবং সেই জায়গাতেই আঘাত করতে চাওয়ার মধ্যে কতখানি লজ্জা আছে, পুলিশকর্তারা সম্ভবত তা ভেবে দেখবেন না। তিনি সন্তানের মা, এবং সেই সন্তানকে অন্য কোথাও রাখার উপায় নেই, এটা তাঁর আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অধিকারকে অস্বীকার করার কারণ হতে পারে না। যে কোনও সভ্য সমাজের কর্তব্য তাঁর সেই অধিকার রক্ষা করা; তাঁর প্রতি সংবেদনশীল হওয়া; সর্বোপরি, তাঁর সন্তানের প্রতি যত্নশীল হওয়া। পুলিশ সেই কর্তব্য পালনে ব্যর্থ, বললে ভুল বলা হবে— পুলিশ সেই কর্তব্যের কথা স্বীকারও করেনি। অথচ, কাজটি খুব কঠিন ছিল না। এই বিক্ষোভকারী মহিলা এমন কোনও ভয়াবহ অন্যায় কাজ করছিলেন না, যার জন্য তাঁকে অবিলম্বে আটক না করে পুলিশের আর উপায় ছিল না। তিনি, এবং তাঁর মতো অন্য যাঁরা সন্তানকে নিয়ে বিক্ষোভে যোগ দিতে এসেছিলেন, পুলিশ তাঁদের প্রথমে সরিয়ে দিতে পারত। তাঁরা সরতে রাজি না হলে বোঝানো যেত। তাতেও কাজ না হলে সে দিন কাউকেই আটক না করে ফিরে যেতে পারত পুলিশ। উর্দি পরলেই কি সংবেদনশীলতা ভুলতে হয়? শিশুর প্রতি দায়িত্বের কথাও বিস্মৃত হতে হয়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy