Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Legislative Council

গণতন্ত্রের স্বার্থে

কিন্তু তাহার জন্য বিধান পরিষদ বা অন্য কোনও প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরের প্রয়োজন নাই, দরকার শুধু শুনিবার ইচ্ছা, শুনিবার অভ্যাস।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০২১ ০৪:৫২
Share: Save:

অবান্তরের সাধনার একটি পীঠস্থান তো বিধানসভা ভবনের অদূরেই রহিয়াছে— রাজভবন। আর কেন? পশ্চিমবঙ্গে বিধান পরিষদ ফিরাইয়া আনিবার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্নটি উঠিতে বাধ্য। দেশের বেশির ভাগ রাজ্যেই আর বিধান পরিষদের অস্তিত্ব নাই। পশ্চিমবঙ্গেও প্রায় অর্ধ শতক পূর্বে এই পরিসরটি বিলুপ্ত হইয়াছিল। তাহাকে ফিরাইয়া আনিবার পক্ষে কোনও সুযুক্তি— বস্তুত কোনও যুক্তিই— রাজ্যের শাসকরা পেশ করিতে পারেন নাই। দশ বৎসর পূর্বে যখন প্রথম এই প্রস্তাব তাঁহারা পেশ করেন, তখনও যুক্তি ছিল না; আজও নাই। আইনসভার কক্ষে যাঁহারা মানুষের প্রতিনিধিত্ব করিবেন, তাঁহারা নির্বাচিত হওয়া জরুরি। তাহাতে মানুষের নিকট জবাবদিহি করিবার দায়বদ্ধতাটুকু অন্তত থাকে। আইনসভার উচ্চতর কক্ষের চরিত্র বিষয়ে ভারত ব্রিটেনের পথে হাঁটিয়াছে— সে দেশে যেমন ‘হাউস অব লর্ডস’, ভারতেও তেমনই রাজ্যসভা; এবং রাজ্য স্তরে বিধান পরিষদের কল্পনা হইয়াছিল। ব্যবস্থা পাল্টানো কঠিন, তাহাতে সন্দেহ নাই— কিন্তু, ‘মনোনীত’ জনপ্রতিনিধির ধারণাটি যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বেমানান, তাহাও স্মরণে রাখা বিধেয়। এই ক্ষেত্রে আমেরিকার সেনেট-এর উদাহরণটি অধিকতর অনুসরণীয়। সে দেশে এই উচ্চতর কক্ষেও প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হইয়াই আসেন।

পশ্চিমবঙ্গে যখন বিধান পরিষদের অস্তিত্ব ছিল, তখনও কি তাহার আদৌ কোনও ভূমিকা ছিল? পরিসংখ্যান বলিতেছে, ১৯৫২ হইতে ১৯৬৭ অবধি যে সময়কালে পশ্চিমবঙ্গে বিধান পরিষদ ছিল, তাহাতে রাজ্যে মোট ৪৩৬টি বিল পাশ হইয়াছিল। দুইটি বাদে বাকি ৪৩৪টি বিল বিধান পরিষদ বিনা প্রশ্নে পাশ করিয়া দেয়। ফলে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপর ‘মনোনীত’-দের নজরদারির যে তত্ত্ব রাজ্যের শাসকরা আমদানি করিতেছেন, তাহা ইতিহাস ও যুক্তির ধোপে টিকিবে না। আরও একটি আশঙ্কার কথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন— যাঁহারা ‘মনোনীত’ হইয়া বিধান পরিষদে আসিবেন, গণতন্ত্রের বলবৃদ্ধি অপেক্ষা নিজেদের আখের গুছাইয়া লইবার তাগিদ তাঁহাদের অনেকের মধ্যেই তীব্রতর হইতে পারে। এই দুইটি উদ্দেশ্যের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা প্রত্যক্ষ— আখের গুছাইতে হইলে বহু ক্ষেত্রেই চক্ষু মুদিয়া থাকিতে হয়; তাহা গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর নহে। শাসকরাও এই কথাটি বিলক্ষণ জানেন। ফলে, বিধান পরিষদের আসনগুলি মূলত আনুগত্যের পুরস্কার হিসাবে বণ্টিত হইবে, অভিজ্ঞতার আলোকে এমন আশঙ্কা প্রবল হইয়া উঠে। রাজকোষের অর্থব্যয়ে এহেন একটি পরিসর বজায় রাখিবার কোনও যুক্তি থাকিতে পারে না।

রাজ্যের শাসকপক্ষ এই প্রস্তাবের পক্ষে একটি কথা বলিয়াছে, যাহা আপাতশ্রবণে বিবেচনার যোগ্য মনে হইতে পারে: এই পরিসরটিতে সমাজের বিভিন্ন বিশিষ্ট জনকে আনিলে শাসনপ্রক্রিয়ায় তাঁহাদের মতামতও শোনা যাইবে। এই শুনিবার ইচ্ছাটিই গণতন্ত্রের প্রাণভ্রমরা। শুধু বিশিষ্ট জনদের মত নহে, যাঁহারা নিতান্ত সাধারণ, এবং সেই কারণেই রাজ্যের শাসনপ্রক্রিয়ার সর্বাধিক প্রভাব যাঁহাদের জীবনে পড়ে, তাঁহারা কী বলিতেছেন, তাহা শোনাও সমান— ক্ষেত্রবিশেষে অধিক— জরুরি। কিন্তু তাহার জন্য বিধান পরিষদ বা অন্য কোনও প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরের প্রয়োজন নাই, দরকার শুধু শুনিবার ইচ্ছা, শুনিবার অভ্যাস। মানুষ কী বলিতেছেন— বিশেষত যাঁহারা সরকারপক্ষের অকুণ্ঠ সমর্থক নহেন, তাঁহারা কী বলিতেছেন, তাহা শুনিবার অভ্যাস যদি শাসকরা করিতে পারেন, এবং সেই কথাগুলিকে যদি প্রাপ্য গুরুত্ব দিতে পারেন, তবে তাহাই গণতন্ত্রের যথার্থ অনুশীলন হইবে। মানুষের মতামতের ছাপ তাঁহাদের শাসনপ্রক্রিয়ায় পড়ুক। তাঁহারা নিজেদের ভুল সংশোধন করিবার সাহস দেখান। তাহাতেই গণতন্ত্র, বিধান পরিষদ ফিরাইয়া আনায় নহে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Legislative Assembly Legislative Council
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE