পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ‘শূন্য’ দেখানো হয়েছে।
রোজ আত্মঘাতী ৩০ জন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো প্রদত্ত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে ভারতে প্রতি দিন গড়ে অন্তত ১৫ জন কৃষক এবং ১৫ জন ভাগচাষি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। আগের পাঁচটি বছরের মধ্যে ২০২১ সালেই কৃষিক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। শীর্ষ স্থানটি মহারাষ্ট্রের। বস্তুত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কৃষক ও কৃষি শ্রমিকের আত্মহত্যার আশি শতাংশই ঘটেছে মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ুতে। তবে এই হিসাবও সম্পূর্ণ চিত্র নয়। কারণ, পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা ‘শূন্য’ দেখানো হয়েছে। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক বছরে সরকারি পরিসংখ্যানে একই চিত্র বিদ্যমান। কৃষিক্ষেত্রে বিপর্যয় নয়, সেখানে কৃষকের অপমৃত্যুর জন্য পারিবারিক বিবাদ, নেশায় আসক্তি বা অসুস্থতাজনিত হতাশার উল্লেখ করে থাকে প্রশাসন। সুতরাং, এই ‘শূন্য’ প্রকৃতই ‘শূন্য’ কি না, প্রশ্ন তোলা সঙ্গত।
সঙ্গত এই কারণেই যে, সারা দেশে কৃষকরা নিয়মিত যে সমস্যাগুলির সম্মুখীন হন, যেমন ফসলের উপযুক্ত দাম না-পাওয়া, বেশি ঋণ নিয়ে শোধ দিতে না-পারা— এগুলির থেকে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের কৃষকরা সম্পূর্ণ মুক্ত, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। সম্প্রতি তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত এক পরিসংখ্যানে জানা গিয়েছে যে, শুধুমাত্র ২০২১ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাতেই ১২২ জন কৃষক এবং ভাগচাষি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। গত বছর পশ্চিমবঙ্গে ধান চাষে অগ্রগণ্য পূর্ব বর্ধমান জেলাতে কয়েক দিনের ব্যবধানে তিন কৃষকের অপমৃত্যুরও খবর মিলেছিল। কিন্তু অসরকারি সমীক্ষা, মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যের প্রতিচ্ছবি সরকারি পরিসংখ্যানে ধরা পড়ে না। নিঃসন্দেহে, অস্বীকারের কারণটি রাজনৈতিক। এতে রাজ্যের কৃষি অব্যবস্থাকে ধামাচাপা দেওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ প্রদানের দায়টি এড়িয়ে যাওয়াও সহজ হয়। কিন্তু একই সঙ্গে তা কৃষিসঙ্কটের প্রকৃত চেহারাটিকে প্রকাশ্যে আসতে দেয় না। ঠিক যে ভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে ডেঙ্গি ও করোনায় মৃতের প্রকৃত তথ্য গোপনের অভিযোগ ওঠে, কৃষিক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় না। ফলত, নীতি নির্ধারণের কাজটি জটিল হয়ে পড়ে।
এটাও সবিশেষ উদ্বেগের, এত আলোচনা সত্ত্বেও সার্বিক ভাবে দেশে কৃষকের পরিস্থিতি অন্ধকারাচ্ছন্নই থেকে যাচ্ছে। কৃষকের সহায়তার জন্য অবিলম্বে সুলভে ঋণদান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চাষির উপর ক্রমবর্ধমান চাপ লাঘব করতে বিকল্প কৃষির ভাবনা, সর্বস্তরের কৃষকের কাছে সেচের সুবিধা পৌঁছনোর মতো বিষয়গুলি নিয়ে তৎপর হতে হবে সরকারকে। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সরকারি নীতির মেলবন্ধন অত্যাবশ্যক। দুর্ভাগ্য, দেশে সেই উদ্যোগ এখনও যথেষ্ট হচ্ছে না। পরিসংখ্যান বলছে, জলবায়ু সংক্রান্ত কারণে এই বছরই প্রথম গম ও চালের উৎপাদন কম হবে। এই ইঙ্গিত শুভ নয়। সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হলে কৃষিক্ষেত্রের প্রকৃত পরিসংখ্যান সামনে এনে তার ভিত্তিতে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে যথোপযুক্ত নীতি নির্ধারণ করতে হবে। কৃষি শুধুমাত্র কৃষক পরিবারের লাভ-ক্ষতির হিসাব নয়, সারা দেশের খাদ্য-নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। সেই নিরাপত্তার প্রশ্নে আপস নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy