—প্রতীকী ছবি।
কাল যে-আমি ছিলাম, প্রমাণ করো/ আজও আমি সেই আমিটাই কি না।”— কবির ‘কাব্যতত্ত্ব’ যে এ কালে প্রযুক্তির প্রবল পরিহাস হয়ে উঠবে, কে ভেবেছিল! বলিউড-অভিনেত্রী থেকে জনপ্রিয় ক্রিকেটার সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে দেখছেন আন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়েছে ‘তাঁর’ ভিডিয়ো বা ছবি, যা মোটেই ‘তাঁর’ নয়! ‘ডিপফেক’ এমনই এক প্রযুক্তি-কৌশল যার দৌলতে অন্য কারও, বিশ্বের যে কারও ছবি বা ভিডিয়োয় মুখচ্ছবি পাল্টে দেওয়া, একের ধড় আর মুণ্ড সূক্ষ্ম ও প্রায়-নিখুঁত ভাবে অন্যের শরীরে জুড়ে দেওয়া জলভাত। রশ্মিকা মন্দানা, ক্যাটরিনা কাইফ, শুভমন গিল নামগুলির ধার-ভারই বুঝিয়ে দেয়, প্রযুক্তির কাছে বিখ্যাত বা প্রভাবশালী মানুষও অসহায়, দেহরক্ষী থাকলেও দেহ বা দেহসজ্জা নিয়ে কাটাছেঁড়া আটকাচ্ছে না। পুরো ব্যাপারটিই ঘটছে বিখ্যাত মানুষটির সম্পূর্ণ অগোচরে, এবং মেশিন লার্নিং ও এআই-জানা কোন মানুষটি কোথায় কোন প্রান্তে বা প্রত্যন্তে বসে এ কাজ করছে, আইনের রক্ষকেরা তা বুঝে ওঠার আগেই আন্তর্জালে সেই জাল ছবি-ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়ে কার্যসিদ্ধি করছে— জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, চরিত্রহনন কিংবা ভয়ঙ্করতর কিছু।
যে প্রযুক্তির সুধায় জীবন হয়ে ওঠার কথা ছিল সুখদ, তারই উপজাত বিষে বেঁচে থাকাটাই বিষাক্ত হয়ে উঠছে, এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী-ই বা হতে পারে। যে মানুষগুলি ডিপফেক-এর শিকার হলেন তাঁরা নেহাত বিখ্যাত বলে চারিদিকে হুলস্থুল পড়েছে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বড় সমাজমাধ্যম-সংস্থাগুলিকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, জাল ছবি-ভিডিয়ো যথাশীঘ্র বাছাই করতে ও সরিয়ে ফেলতে হবে, প্রযুক্তির অপব্যবহার রুখতে রাতারাতি আইন দণ্ড জরিমানার ব্যবস্থা হচ্ছে, কিন্তু এতেই কি এই কুকাজ রুখে দেওয়া যাবে? ডিপফেক-কাণ্ড বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, প্রযুক্তির জুজু আর দূরে কোথাও নেই, এসে পড়েছে একেবারে রোজকার যাপনের মধ্যে, এবং সবচেয়ে বড় কথা, তার শিকার হতে পারেন বিশিষ্ট ও সাধারণ, ধনী ও নির্ধন, আকবর বাদশা ও হরিপদ কেরানি একই সঙ্গে, সমান ভাবে। প্রযুক্তি মাধ্যমে নানা রকম আর্থিক প্রতারণার ঘটনা বেড়েই চলেছে, এ বার ডিপফেক সহায়ে রাজনীতি থেকে ধর্ম, সমাজ— যে কোনও পরিসরে যে কাউকে প্যাঁচে ফেলার পথ প্রশস্ত হল। রাজনীতি এখন বহুলাংশে প্রযুক্তি-প্রভাবিত, বিজেপির আইটি সেল-এর কথাও ‘সুবিদিত’, রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আবহে ও আগামী বছর লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে কেন্দ্রের শাসক দল ও তার প্রযুক্তি-সেনার হাতে এ জিনিস যে বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের অপদস্থ করে ভোটের হাওয়া ঘোরানোর কল হয়ে উঠবে না, কে বলতে পারে!
প্রযুক্তির আলো ছাড়া জীবন চলবে না, আবার প্রযুক্তির অন্ধকারও জীবনকে গ্রাস করবে, এ-ই তার মানে সমাজের ভবিতব্য। প্রশাসন, আইন ও বিচারব্যবস্থার হস্তক্ষেপে এই অন্ধকার হয়তো কিছুটা দূর হবে, কিন্তু তা এক বিরাট মূল্য চোকানোর আগে নয়। সেই মূল্যটি হল বিশ্বাস— সহমানুষের উপর মানুষের বিশ্বাস, এক প্রতিষ্ঠানের উপর অন্য প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাস। অর্থনীতির তত্ত্ব বলে, উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক আস্থার এক নিবিড় সম্পর্ক আছে। আর্থিক বিনিয়োগ ও লগ্নির মূলগত ভিত্তিই হল বিশ্বাস, চার পাশে ঘৃণা অবিশ্বাস বিভেদ ও মিথ্যা জমতে থাকলে সে সমাজে ‘হিউম্যান ক্যাপিটাল’ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে, তার প্রকোপ পড়ে অর্থনীতিতে। রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষেত্রেও কি একই কথা প্রযোজ্য নয়? আজ প্রযুক্তি নিজের হাতে থাকার জোরে কিছু মানুষের হাতে অন্য কিছু মানুষের মান যশ অর্থ প্রতিপত্তি খর্ব হওয়া শুরু হয়েছে, সে-দিন দূরে নয়, যখন এই প্রযুক্তি অনেকের বা সকলেরই আয়ত্ত হবে। তখন কি শুরু হবে এক অমোঘ মুষলপর্ব— প্রযুক্তি সহায়ে যে কারও বিরুদ্ধে যা কিছু করবার স্বেচ্ছাচার? উত্তর জানা নেই, প্রযুক্তিলাঞ্ছিত এই সময় বেআব্রু প্রশ্নগুলো তুলে ধরছে কেবল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy