মা ও তার সদ্যোজাতরা যাতে সুস্থ থাকে, তার জন্য নানাবিধ প্রকল্প, প্রসূতি ও শিশুদের নিখরচায় বাড়ি থেকে হাসপাতালে আনা এবং চিকিৎসা শেষে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১০২ অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা, নিশ্চয় যান-সহ বিভিন্ন বিশেষ ব্যবস্থা করেছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন জেলায় পর পর প্রসূতি-মৃত্যু ঘটতে থাকে, এবং মৃত্যুর কারণগুলিতে এক অদ্ভুত যোগসূত্র লক্ষ করা যায়, তবে তা উদ্বেগের কারণ। গত এপ্রিলে পশ্চিমবঙ্গে ১০৭ জন প্রসূতির মৃত্যু ঘটেছে। ঠিক তার আগের বছর এই এপ্রিলেই প্রসূতি-মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১০৩। অর্থাৎ, সংখ্যাগত দিক থেকে পরিবর্তনটি অ-স্বাভাবিক নয়। কিন্তু যে চারটি অঞ্চলে প্রসূতি-মৃত্যু গত বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে, তার প্রত্যেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ বলে মনে করা হচ্ছে অস্ত্রোপচারের পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণকে।
প্রসঙ্গত, প্রসবের সময় প্রসূতি ও সদ্যোজাতদের মৃত্যুহার হ্রাস করতে ভারতে বিশেষজ্ঞরা প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। নিরন্তর সরকারি প্রচার, এবং চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়েছেন মানুষ। তার সুফলও দেখা দিয়েছে। বর্তমানে দেশে এক লক্ষের মধ্যে প্রসূতি-মৃত্যুর হার ৯৭। পশ্চিমবঙ্গে সেই সংখ্যা ৯৫-এর নীচে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। শুধু লক্ষ্যমাত্রাই নয়, প্রসূতিমৃত্যু ঠেকাতে অস্ত্রোপচারের জটিলতা এড়িয়ে স্বাভাবিক প্রসবের উপর গুরুত্ব দান, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পরিকাঠামোগত ত্রুটি যাতে মৃত্যুর কারণ না হতে পারে তার জন্য ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থা করা-সহ বিভিন্ন বিষয় সরকারি স্তরে আলোচিত হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা যে তাতে সম্পূর্ণ দূর হয়নি, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। বিষয় যখন প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব, তখন প্রসব-পরবর্তী চিকিৎসা যথাসম্ভব ত্রুটিমুক্ত রাখা প্রয়োজন, যে কোনও গাফিলতির অভিযোগ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে দেখা উচিত। কারণ, সে ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নতুন মায়ের প্রাণসংশয়ই হয় না, বৃহদর্থে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের প্রতি মানুষের আস্থার বিষয়টিও প্রভাবিত হতে পারে।
এপ্রিলে চারটি জায়গায় প্রসূতি-মৃত্যু বৃদ্ধির কারণ হিসাবে প্রসব-পরবর্তী চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। অথচ, ব্যবহৃত ওষুধের নমুনা পরীক্ষায় কোনও গোলমাল ধরা পড়েনি। আশ্চর্য এটাই যে, ওই চার জায়গাতেই পরীক্ষামূলক ভাবে অন্য ওষুধ ব্যবহারের পর মৃত্যুসংখ্যা শূন্য-তে এসে দাঁড়িয়েছে, এমনকি পুরনো ওষুধের প্রয়োগ ফের শুরু হলেও অঘটন ঘটেনি। অতঃপর প্রশ্ন উঠেছে, কোনও নির্দিষ্ট ব্যাচের ওষুধের প্রয়োগেই এমন অঘটন ঘটেছিল কি না। যদি সেই সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হয়, তবে আরও গুরুতর প্রশ্ন— নমুনা পরীক্ষায় ব্যবহৃত ওষুধগুলি পাশ করল কী ভাবে? অর্থাৎ, ত্রুটি এখানে বহুস্তরীয়। নিরপেক্ষ ভাবে সেই ত্রুটির উৎসটি খুঁজতে হবে। ওষুধ যদি দায়ী না হয়, তবে অন্য কোন কারণে এমন অঘটন ঘটল, সেটিও জানতে এবং জানাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে তদন্ত কমিটি গঠন করে দ্রুত তার রিপোর্ট জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। সেই অনুযায়ী আগামী দিনে হাসপাতালগুলিরও প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করা উচিত, যাতে আর কোনও সদ্যোজাতকে জন্মলগ্নেই মাতৃহারা হতে না হয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)