সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করা হয়েছিল, লিভ-ইন তথা একত্রবাসের মতো সম্পর্ককে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নথিভুক্ত করাতে হবে। ফাইল ছবি।
সেই সরকারই সবচেয়ে ভাল যে সবচেয়ে কম শাসন করে, বলেছিলেন হেনরি ডেভিড থোরো। ‘শাসন’ শব্দটিতে এখানে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে: সরকারের কাজ শাসন করা তো বটেই, কিন্তু এমন ভাবে যা শাসন বলে, নিরন্তর ছড়ি ঘোরানো বলে বোধ না হয়। ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে নাগরিককে শাসন করার এক তীব্র বাসনা রয়েছে, প্রায়শই তা প্রকট হয়ে পড়ে। সম্প্রতি যেমন সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করা হয়েছিল, লিভ-ইন তথা একত্রবাসের মতো সম্পর্ককে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নথিভুক্ত করাতে হবে— আদালত যেন এমন নির্দেশ দেয়। কী কারণে নথিভুক্তি? কারণ, লিভ-ইন সম্পর্কে নানা অপরাধের ঘটনা ঘটছে, দিল্লিতে শ্রদ্ধা ওয়ালকরের হত্যাকাণ্ড যেমন। লিভ-ইন সম্পর্কে থাকা দু’জন মানুষের বিশদ তথ্য নথিভুক্ত থাকলে সম্পর্ক শুরুর সময়েই তাঁরা একে অন্যের সম্বন্ধে সব জেনে যাবেন, এবং সবচেয়ে বড় কথা, সরকারের কাছেও তাঁদের সম্পর্কে সব তথ্য থাকবে, কোনও অবাঞ্ছিত ঘটনায় সুরক্ষা দান তাতে সহজ হবে। শীর্ষ আদালত এ আবেদন শুধু খারিজই করেনি, প্রধান বিচারপতি বিরক্তি সহকারে যা বলেছেন তার মর্মার্থ: লিভ-ইন’এর নথিভুক্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের মাথাব্যথার কোনও কারণ থাকতে পারে না, লিভ-ইন নিয়ে সরকার এত চিন্তা করা ছাড়ুক।
আদালতের ধমকে কেন্দ্রীয় সরকার আপাতত দমে গেলেও, লিভ-ইন নিয়ে পরেও যে তারা তেড়েফুঁড়ে উঠবে না, তা বলা যাচ্ছে না একেবারেই। কারণটি সেই গোড়ার কথা, নাগরিককে ‘শাসন’ করার প্রবৃত্তি। বিজেপি ও তার সরকারের এই প্রবৃত্তি এমনই দুর্মর যে নাগরিকের ঘরের ভিতরে, চার দেওয়ালের মধ্যে নাক ও মাথা দুই-ই গলাতে চায়, ভাতের হাঁড়ির খবর জানতে চায়, ফ্রিজের মধ্যে রাখা মাংস কোন ‘জাত’-এর তা জানতে তার বিলক্ষণ আগ্রহ। নাগরিকের ব্যক্তিগত পরিসরগুলিকে নিজের শাসনক্ষেত্র ভাবতে এই দল ও সরকারের বিন্দুমাত্র বাধে না— দুই ধর্মপরিচয়ের দু’টি মানুষ সম্পর্ক গড়লে তাদের সম্পর্কছাড়া করাই এদের একমাত্র কাজ, এমনকি সেই লক্ষ্যে তারা রাজ্যে রাজ্যে আইন পর্যন্ত করে ফেলেছে। চিরাচরিত সম্পর্ক-কাঠামোর বাইরে থাকা লিভ-ইন’ও যে এদের সহ্য হবে না, বলা বাহুল্য। সুপ্রিম কোর্ট-সহ ভারতের বহু আদালত যখন লিভ-ইন সম্পর্কের বৈধতা, লিভ-ইন সম্পর্কে থাকা মানুষের অধিকার নিয়ে নানা সময়ে বার বার মন্তব্য করেছে, রায় দিয়েছে, বিজেপি তখন এই সম্পর্ককে বলে এসেছে ‘অ্যান্টি-হিন্দু’, এর আইনি বৈধতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ করে গিয়েছে।
এত করেও যখন শেষরক্ষা হল না, তখন একটাই কাজ বাকি থাকে, নিয়ন্ত্রণ। কেন্দ্রীয় সরকারের ঘরে লিভ-ইন’এর নথিভুক্তকরণের আবেদন সেই নিয়ন্ত্রণের সহায়ক হত। সরকারের কাছে দু’জন মানুষের সব ব্যক্তিগত তথ্য রাখা বাধ্যতামূলক করা হলে সুরক্ষার অছিলায় তাঁদের চোখে চোখে রাখা নিশ্চিত করা যেত। শীর্ষ আদালত এই কৌশলটি ধরে ফেলেছে; মামলাকারীর আইনজীবীকে প্রশ্ন করেছে আসল উদ্দেশ্য কোনটি, লিভ-ইন’এ থাকা যুগলদের সুরক্ষা বাড়ানো, না কি তাঁদের একত্রবাসে ইতি টানতে চাওয়া। যে কোনও পরিস্থিতিতে নাগরিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব, শুধু লিভ-ইন’এ নয়। নানা বাহানায় কেন্দ্রীয় সরকারের ‘শাসন’ করতে চাওয়ার মতলবটি ভেস্তে গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy