E-Paper

প্রদীপের নীচে

আত্মহত্যার বহুবিধ কারণের মধ্যে সর্বাগ্রে উঠে এসেছে পঠনপাঠনের অত্যধিক চাপের কথা, যা ক্ষেত্রবিশেষে মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করে তুলছে।

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০২৩ ০৪:৩১
A Photograph representing a dead body

প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইআইটিগুলিতে গত তেষট্টি মাসে তেত্রিশ জন পড়ুয়া আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। প্রতীকী ছবি।

শিখা যতই উজ্জ্বল হোক না কেন, অন্ধকারের ছায়াটি প্রদীপের সঙ্গ ছাড়ে না। ভারতের প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইআইটিগুলিতে গত কয়েক মাসে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান এই প্রবাদবাক্যটিকেই আরও এক বার মনে করিয়ে দেয়। ২০১৮ সালের গোড়া থেকে শুরু করে গত তেষট্টি মাসে সেখানে তেত্রিশ জন পড়ুয়া আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। অন্য একটি চিত্রও আছে, যা তুলনায় কম আলোচিত, কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ— যত জন আত্মহত্যা করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতিনিয়ত আত্মহত্যার কথা ভাবে, এমনকি চেষ্টাও করে।

ছবিটি সবিশেষ উদ্বেগজনক। আইআইটিগুলির বিভিন্ন তদন্ত রিপোর্টে আত্মহত্যার বহুবিধ কারণের মধ্যে সর্বাগ্রে উঠে এসেছে পঠনপাঠনের অত্যধিক চাপের কথা, যা ক্ষেত্রবিশেষে মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। যারা নম্বরপ্রাপ্তির দিক থেকে তুলনামূলক ভাবে পিছিয়ে থাকছে, মূলত তারাই এই চাপের শিকার। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলার থেকে যায়। প্রথমত, আইআইটি ক্যাম্পাসগুলিতে শিক্ষার্থীদের পঠনপাঠন সংক্রান্ত মানসিক চাপ সামলানোর জন্য সহায়তা প্রদানকারী পরিকাঠামো আছে। তা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের চাপ সামলাতে ব্যর্থতা সেই পরিকাঠামোর কার্যকারিতা কোথায়? বিশেষজ্ঞদের একাংশ শুধুমাত্র কয়েক জন অতিরিক্ত মনোবিদ নিয়োগ করার পরিবর্তে আইআইটি-র পঠনপাঠন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন। যে প্রস্তাবগুলি এর পরিপ্রেক্ষিতে উঠে এসেছে, তাতে নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যাদের বিশেষ সাহায্যের প্রয়োজন, তাদের জন্য ‘শিক্ষণ সহায়ক’ নিয়োগের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, যাঁরা প্রথম মাসেই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে এই ধরনের ছাত্রছাত্রীদের বিষয়ে ওয়াকিবহাল করবেন। তদনুযায়ী কর্তৃপক্ষ কি বিদেশের উদাহরণ অনুযায়ী এই পড়ুয়াদের জন্য পৃথক ক্লাস নেওয়া-সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ করবেন, যাতে এদের সুবিধা হয়? কিন্তু তা সত্ত্বেও যারা কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করতে পারবে না, তাদের ক্ষেত্রে কী করণীয়? সংবেদনশীলতার সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ব্যবস্থা করা কি একেবারেই অসম্ভব?

দ্বিতীয়ত, সমস্যা কি কেবলই নম্বর সংক্রান্ত? বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, আর্থ-সামাজিক ভাবে যারা পিছিয়ে, তাদের অসুবিধাই বেশি, এবং সেই অসুবিধা আসলে নানা প্রকারের। দলিত কিংবা জনজাতীয় কিংবা সংখ্যালঘুদের অসুবিধা কেবল নম্বর বিষয়ক কি না, কিংবা নম্বর কম থাকলে তার পিছনে গভীরতর বঞ্চনার ভূমিকা আছে কি না, সংবেদনশীল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তা বিবেচনা করা উচিত। রোহিত ভেমুলার উদাহরণ স্মর্তব্য। প্রকৃত মুশকিল অবশ্য ‘সংবেদনশীল’ এই বিশেষণটি নিয়েই। কেবল আইআইটি নয়, বেশির ভাগ উৎকর্ষমুখী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংবেদনশীলতা বিষয়টিকে সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য— এমনকি দুর্বলতা— বলে মনে করে। প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া, প্রত্যাশিত ফল করতে না পারা মানেই যে জীবন সম্পূর্ণ ব্যর্থ— এই নেতিবাচক ভাবনা পড়ুয়াদের মনে জোর করে ঢুকিয়ে দেয় এই প্রতিষ্ঠানগুলিই। ব্যর্থ শিক্ষার্থী মানেই নিষ্ফল ও বাতিলের দলে, হীন গোত্রভুক্ত— এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এই মানসভূমি সফল ভাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। আইআইটি তো হিমশৈলের চূড়ামাত্র।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

IIT Mysterious death Mental Health

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy