অসমের এক স্কুলছাত্রীকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরার অনুমতি দিল গৌহাটি হাই কোর্ট। নয় বছরের পুরনো মামলা, ২০১৩ সালে যখন ক্যাথলিক মিশনারি পরিচালিত স্কুল কর্তৃপক্ষ মেয়েটির হিজাব পরে ক্লাসে আসায় আপত্তি করে, তখন সে নার্সারির ছাত্রী— এখন অষ্টম শ্রেণির। স্কুল বলেছিল ইউনিফর্ম-বিধি মানতে হবে, নয়তো মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে হবে না। মেয়েটির হয়ে তার মা মামলা লড়ে গিয়েছেন, প্রথমে নিম্ন আদালতে, পরে হাই কোর্টে; আবেদনে জানিয়েছিলেন, তাঁদের এলাকায় ওই একটিই ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, কেরলের মুসলিম পরিবার থেকে আসা তাঁদের পক্ষে তাই অন্য কোনও স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করা সম্ভব নয়। আবার ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মান্য বিধি অনুসারে হিজাব না পরাও অসম্ভব। স্কুল কর্তৃপক্ষ ‘মেয়েটির স্বার্থে’ অষ্টম শ্রেণি অবধি তাকে স্কুলে হিজাব পরে আসার অনুমতি দিয়েছিল, আদালতের সাম্প্রতিক রায়ে বাকি দুই বছরও সে স্কুলে হিজাব পরতে পারবে। তবে হাই কোর্ট স্পষ্ট করে দিয়েছে, স্কুলের এই সম্মতিদান ‘সম্পূর্ণত মানবিকতার খাতিরে’, আবেদনকারীর আইনি অধিকারের নিশ্চয়তাসূচক নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ যা: পরবর্তী কালে কেউ কোনও ভাবে এই রায়কে পূর্ব-উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন না।
দীর্ঘ কাল ধরে চলা মামলার টানাপড়েন পেরিয়ে, আদালতের রায়ে মেয়েটি ও তার মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারলেন, এ নিশ্চয়ই সুখের কথা। বিশেষত কিছু দিন আগেই কর্নাটক হাই কোর্ট যেখানে হিজাব পরাকে আবশ্যিক ধর্মাচরণ হিসাবে মানেনি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইউনিফর্ম-বিধি প্রসঙ্গে বিজেপি-শাসিত রাজ্য সরকারের নির্দেশকেই মান্যতা দিয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই রায় আরও স্বস্তিদায়ক। তবু গৌহাটি হাই কোর্টের রায় বিশেষ পরিস্থিতিতে নিতান্ত মানবিকতার খাতিরে, তা আবেদনকারীর আইনি অধিকারের পরিচায়ক নয়, আদালতের এই মন্তব্যে অস্বস্তি জাগে। এই রায়কে শুধু এই একটি মামলার ক্ষেত্রেই বেঁধে দেওয়া, ভবিষ্যতে একে পূর্ব-উদাহরণ হিসাবে ব্যবহারের পথটিকে আদালতের তরফেই বন্ধ করে দেওয়া— প্রশ্ন ওঠে তা নিয়েও। এবং সেই প্রশ্নও সঙ্গত, কারণ বিষয়টি বহুচর্চিত সাংবিধানিকতার, সংবিধান-স্বীকৃত অধিকার রক্ষা ও নিশ্চিত করা নিয়ে। হিজাব পরা ধর্মবিশেষের আবশ্যক বিধি কি না, তা না মানলে সেই ধর্মের গৌরব বা সারবত্তার হানি হবে কি না— এই সব প্রশ্নেরও পরে, এবং প্রশ্নগুলির কেন্দ্রে রাখা ‘ধর্ম’ বিষয়টিরও উপরে জেগে থাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ ও মূলগত একটি বিষয়— ব্যক্তি নাগরিকের সমানাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, জীবনাচরণের স্বাধীনতা। সংবিধানের ১৪, ১৫, ১৯, ২১, ২৫ সংখ্যক অনুচ্ছেদগুলি একক ও সামগ্রিক ভাবে সেই অধিকারকেই সূচিত করেছে, আগের শতসহস্র মামলায় ভারতের বিভিন্ন আদালতই সেই অধিকার নিশ্চিত করেছে। ধর্মের অনগ্রসরতার প্রশ্ন এ নয়, প্রশ্ন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে নাগরিকের নিজস্ব পছন্দের অভ্যাসকে রাষ্ট্র ও তার আইন কোন চোখে দেখছে, তা। সরকার ও আইন যদি বিভেদের চোখে দেখে, আদালতের কাজ সেই বিভেদ নির্মূল করা। শুধু একটি মামলায় মানবিকতা প্রদর্শনে নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার সামগ্রিক ও জরুরি কাজটি করা গেল কি?
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy