নয় রাজ্য ও তিন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নিয়ে, আনুমানিক ৫১ কোটি মানুষের ভোটার পরিচিতি নির্ণয়ের রাজসূয় যজ্ঞ তবে শুরু হল। এই তালিকার চারটিতে পরের বছর বিধানসভা ভোট। তবে এক অত্যাশ্চর্য প্রচারের দৌলতে পশ্চিমবঙ্গের দিকেই সমগ্র দেশের নজর। তামিলনাড়ু বা পুদুচেরির এসআইআর-এর সঙ্গে তার বিপুল ফারাক— যদিও পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু তালিকার একমাত্র বিরোধীশাসিত রাজ্য নয়। বিহারে এসআইআর চলাকালীনই পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে কেন্দ্রীয় শাসক, প্রাদেশিক শাসক, অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী— সকলেরই এসআইআর প্রচার তুঙ্গে উঠেছিল এমন ভাবে, যাতে সমগ্র দেশের মধ্যে এই রাজ্যের ‘গুরুতর’ স্থানটি কেবল জনমানসে নয়, বাস্তবের মাটিতেও বিলক্ষণ প্রোথিত হয়েছে। খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারংবার বলেছেন অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে খুঁজে বার করে তাড়ানোর কথা, যাদের নাকি পশ্চিমবঙ্গে স্বাগত জানানো হয় বলেই এখানে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান। বিজেপির তরফে উল্লসিত প্রচার চলেছে কয়েক কোটি ভোটারকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অভিপ্রায় জানিয়ে। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা উত্তরে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। অথচ, ভোটার তালিকা সংশোধন একটি সাধারণ সাংবিধানিক কাজ হওয়ারই কথা ছিল। ২০০২ সালে শেষ বার যখন এই প্রক্রিয়া হয়েছিল, তখনকার কোনও তরফেই এমন ভয়ঙ্কর প্রচার কিংবা বিরোধিতা কেউ স্মরণ করতে পারবেন না, কেননা তথাকথিত ‘বিপজ্জনক’ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও নিরাপদে ও রুটিন পদ্ধতিতেই সেই পর্ব সমাধা হয়েছিল। সে বারও মৃত ও ভুয়ো ভোটারদের নাম বাদ গিয়েছিল, তাতে নিশ্চয় নানা ভ্রান্তি, ত্রুটি, দুর্বলতা ছিল। কিন্তু কোনও ধর্মীয় বা গোষ্ঠী পরিচয়কে লক্ষ্য করে সংঘাত বা বিদ্বেষের এমন তীব্র আবহ তৈরি হয়ে ওঠেনি।
এই প্রক্রিয়ার পরিচালক মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার, কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সমানেই নিজের ওজনদার মন্তব্য পেশ করে চলেছেন। তাঁকে ও তাঁর অনুচরদের বলা দরকার, আর প্ররোচনা নয়, সাংবিধানিক পদ্ধতি মান্য করে প্রক্রিয়া সংঘটিত করুন। তবে আশঙ্কা, তাঁদের জন্য যে কোনও শব্দব্যয়ই অর্থহীন। তাঁরা শব্দজিৎ— সব সমালোচনা বা বিরোধিতার উত্তরের দায় বর্জন করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে ৫৫ শতাংশ ‘ম্যাপিং’-এর পর ৪৫ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষের নথি মেলানো আবশ্যক। নির্ধারিত সময়ে তা যথার্থ ভাবে হওয়া অসম্ভব— আশঙ্কা স্বাভাবিক। বিহারে যে ৬৫ লক্ষের নাম বাতিল হয়েছে, তার মধ্যে জীবিত ৩৬ লক্ষকে কেবল অনুপ্রবেশ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। দারিদ্র-অশিক্ষা-অসচেতনতা অধ্যুষিত রাজ্যে বহু প্রান্তিক মানুষ, বহু নারী ‘নথি দেখানো’র অপারগতায় বাদ পড়েছেন। বিরোধীরা অজস্র পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা তুলে ধরেছেন। সুপ্রিম কোর্টে এখনও মামলা চলমান। কিন্তু তার নিষ্পত্তির আগেই এতগুলি রাজ্যে এসআইআর চালু হল, এতই (রাজনৈতিক) তাড়া। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের তাড়ানোর হুমকি, নিম্নবর্ণ হিন্দুকে সিএএ-র জালে উদ্ধার করার আশ্বাস, এই যুগ্ম প্রচারেই স্পষ্ট— এসআইআর যা হওয়ার কথা আর যা হচ্ছে, তার মধ্যে কতখানি ফারাক।
তবু, আশঙ্কা ও আতঙ্কের বশবর্তী না হয়ে, এবং সব তরফের রাজনীতির অস্থিরতা ও উদ্বেগ তৈরির চক্রান্তকে ব্যর্থ করে যাতে এই প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ভাবে শেষ হয়, তা দেখা রাজ্যবাসীর কর্তব্য, রাজ্যবাসীরই দায়। পশ্চিমবঙ্গকে বুঝতে হবে, ঠিক যে কারণে তার সীমান্ত-অতিক্রমণ ও ধর্মভিত্তিক অনুপ্রবেশে জনবিন্যাস বদলে যাওয়া নিয়ে দেশময় এত ভিত্তিহীন চিৎকৃত প্রচার, সেই দেশভাগ ট্র্যাজেডির বেদনা মনে রেখেই এ রাজ্যের শান্তি ও স্থিতি রক্ষা অতীব জরুরি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গরম হুমকি ও নরম উস্কানি থামিয়ে বিবেচনাবোধ ব্যবহার করুন। তাঁর সরকারের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উপরেই কিন্তু গোটা রাজ্যের শান্তি-স্বস্তি নির্ভর করছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)