কুকুরের হামলার বাড়বাড়ন্তের কারণে দিল্লির জাতীয় রাজধানী এলাকার আবাসিক অঞ্চল আট সপ্তাহের মধ্যে পথকুকুর-মুক্ত করার নির্দেশ পরিমার্জন করল সুপ্রিম কোর্ট। নতুন সিদ্ধান্তটি ১৯৬০-এর পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা-বিরোধী আইন ও ২০২৩-এর পশুজন্ম নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। পথকুকুরদের দিল্লির রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে নির্বীজকরণ ও টিকাকরণের পরে, রেবিজ় আক্রান্ত বা অসুস্থ কুকুর ব্যতিরেকে বাকিদের পূর্বতন এলাকায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তবে, রাস্তায় কুকুরদের খাওয়ানোর অনুমতি দেয়নি আদালত। পুরসভার নির্দিষ্ট করা এলাকা ভিন্ন অন্যত্র কুকুরদের খাওয়ালে আইনি পদক্ষেপ করা হতে পারে।
বিচারবিভাগের বিবেচনার প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আস্থা রেখেই বলা যায়, নতুন রায় পাকাপাকি পৃথকীকরণের কঠোরতা থেকে সরে এলেও, এই নীতির ব্যবহারিক প্রয়োগে এখনও বেশ অসুবিধা হতে পারে। দ্বিমত নেই যে, পথকুকুর সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে প্রশাসনের দীর্ঘ দিনের ব্যর্থতার কারণেই বিশ্বের রেবিজ় বা জলাতঙ্কে মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ঘটছে ভারতে। সমস্যাটি প্রবল, কিন্তু তার জন্য কুকুরদের ‘শাস্তি’ দেওয়া যথাযথ কি? মানুষ তার ক্ষমতাবলে সব পরিসর দখল করে নেয়, কিন্তু সে দখলদারিকেই ন্যায্য জ্ঞান করা মুশকিল। ব্যাপক হারে জলাতঙ্ক টিকাকরণ ও নির্বীজকরণই এ ক্ষেত্রে সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান। কুকুরের সংখ্যার বাড়বাড়ন্ত কমলে তাদের মধ্যে খাবার ও সঙ্গীর জন্য রেষারেষি, অপুষ্টি, রোগযন্ত্রণা এবং মানুষ-পশু সংঘাতও কমবে। এর পরেও যে কুকুরগুলি আগ্রাসী ও অসুস্থ বলে চিহ্নিত হবে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে এনে মানবিক ভাবে নজরাধীন ও বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। কোনও এলাকায় পশু-আক্রমণের ঘটনা বাড়লে পুরসভাকে তৎক্ষণাৎ উপযুক্ত ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
কুকুর নিয়ে মানুষের মতামত বরাবরই দ্বিধাবিভক্ত। এক দল এদের যত্ন কর্তব্য মনে করেন এবং অন্য দল উপদ্রব হিসাবে দেখেন। আশঙ্কা হয়, রাস্তায় কুকুর খাওয়ানো নিয়ে আদালতের নির্দেশের ফলে এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত প্রবলতর হবে। এই পরিস্থিতিতে কেউ বলতে পারেন, আদালতের নির্দেশের মাধ্যমে সমস্যার সমাধানসূত্র খোঁজার বদলে তার খোঁজ করতে হবে সমাজের পরিসরে। যাঁরা পথকুকুর-বিরোধী, তাঁদেরও যেমন বুঝতে হবে যে, ক্ষমতার জোর আছে বলেই সব পরিসরে শুধু মানুষেরই অধিকার থাকতে পারে না; তেমনই পশুপ্রেমীদেরও স্বীকার করতে হবে যে, পশুর স্বাস্থ্য ও আচরণের দায় এড়িয়ে গণপরিসর ময়লা করে খাবার দেওয়া মমতা নয়, দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়। ভালবাসতে হলে দায়িত্বও নিতে হবে। পথপশুকে যত্নের কিছু নিয়ম আছে। রাষ্ট্র ও পশুপ্রেমী উভয় পক্ষই সেগুলি যথাযথ ভাবে পালন করলে সকলেই সুস্থ, নিরাপদ ও শান্তিতে থাকবেন। পথকুকুর নিয়ে বর্তমান বিতর্কের চরিত্রটি দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সামাজিক স্তরে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানসূত্র নির্ণয়ের স্বাভাবিক, সুস্থ প্রক্রিয়াটিকে এই সমাজ কত দূর বিস্মৃত হয়েছে। তা অতি দুর্ভাগ্যের। এবং, তা আসলে নির্দেশ করে এই সমাজের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার গুরুতর অভাবের দিকে। সামাজিক বিশ্বাসে ঘাটতি হলে তা শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছয়, ইতিহাসে তার উদাহরণ কম নেই। অতএব, সতর্কতা জরুরি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)