গাজ়িয়াবাদের বাসিন্দা বছর একত্রিশের মহিলা কখনও ধূমপান করেননি। অথচ দ্বিতীয় পর্যায়ের ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত তিনি। এমন ঘটনা অনেক। ফুসফুসের ক্যানসার প্রধানত ধূমপায়ী, পঞ্চাশোর্ধ্ব এবং পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এ ধারণা বদলে ফেলার সময় এসেছে। মারণরোগ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে অধূমপায়ীদের, বিশেষত মহিলাদের মধ্যে। ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চ-এর তথ্য বলছে, এই বছর ভারতে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছবে ৮১ হাজারের কাছাকাছি। উদ্বেগের বিষয় হল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগটি ধরা পড়ছে একেবারে শেষ পর্যায়ে, যখন হাতে সময় বিশেষ থাকছে না। বিশ্ব জুড়ে যে সব অ-সংক্রামক রোগ প্রায় মহামারি হয়ে উঠেছে, ফুসফুসের ক্যানসার তার অন্যতম। প্রতিরোধের উপায় হিসাবে সাধারণত ধূমপান, বিষাক্ত ধোঁয়া এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। সেই পরামর্শ মূল্যবান। কিন্তু রোগবিস্তারের ক্ষেত্রে যখন দেখা যায় ব্যতিক্রমের সংখ্যা ক্রমশ বর্ধমান, তখন কারণ অনুসন্ধানে প্রচলিত ধারণার বাইরে হাঁটা জরুরি হয়ে ওঠে।
অধূমপায়ী এবং মহিলাদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসাবে উঠে আসছে দূষণের কথা। দূষণ শুধুমাত্র বাইরের নয়, ঘরের ভিতরেরও। বছর দুয়েক আগে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান মন্ত্রকের সমীক্ষায় উঠে এসেছিল, বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘উজ্জ্বলা যোজনা’য় গরিব মহিলাদের নিখরচায় রান্নার গ্যাসের সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা হলেও দেশে অর্ধেকেরও কম পরিবারে রান্নার কাজে গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে এখনও রান্নার কাজে প্রধানত কাঠকুটো, শুকনো পাতাই ভরসা। পরিবারের রান্না থেকে মিড-ডে মিল সবই হচ্ছে তার সাহায্যে। খাস কলকাতাতেও উনুনে, কারখানার ছাঁটের কাঠে রান্নার প্রবণতা বজায় আছে। অথচ, উজ্জ্বলা যোজনার মূল উদ্দেশ্য ছিল ধোঁয়ার বিষ থেকে মহিলাদের মুক্তি। সে মুক্তি আজও অধরা। তদুপরি, রয়েছে অধিকাংশ রান্নাঘরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যেখানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের পথ থাকে না। দমবন্ধ পরিবেশে, ধোঁয়ার মধ্যে আজও দেশের অসংখ্য মহিলার দিনের অধিকাংশ সময় কাটে।
এক অবস্থা ঘরের বাইরের দূষণের ক্ষেত্রেও। হেমন্তের শুরু থেকে পরবর্তী বেশ কয়েক মাস দিল্লি-সহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলি যে অসহনীয় বায়ুদূষণের শিকার হয়, বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি প্রবল ভাবে বেড়ে যায়, তা-ও কি ফুসফুসের ক্যানসারে ইন্ধন জোগায় না? কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে দেশে ২০১৯-এ চালু হয় ‘ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম’, ২৪টি রাজ্যের ১৩১টি শহরের বায়ুদূষণ হ্রাসের লক্ষ্য নিয়ে। অথচ, ষোলোটি ভারতীয় শহরের লাগামছাড়া বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে এ-যাবৎ ১০০০ কোটির কাছাকাছি বরাদ্দ করা হলেও বিশ্বের সর্বাধিক দূষিত ৫০টি শহরের তালিকায় সেই ষোলোটি শহর জায়গা করে নেয়। এক দিকে, দেশের শীর্ষনেতৃত্ব থেকে আধিকারিকরা আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে উন্নত দেশের দায়িত্ববোধের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। অন্য দিকে, দেশেরই অসংখ্য মানুষ, গরিব পরিবারের মেয়েরা নির্মল বাতাসের অভাবে রোগাক্রান্ত হচ্ছেন, মৃত্যুর অপেক্ষা করছেন। এ খেলা চলছে নিরন্তর।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)