নির্মীয়মাণ বাড়ি বৈধ কি না, তা জানার জন্য বাড়ির সামনে ‘কিউআর কোড’-সহ একটি বোর্ড রাখার পরিকল্পনা করেছে কলকাতা পুরসভা। স্মার্ট ফোনে ওই ‘কোড’ স্ক্যান করলেই ক্রেতা জানতে পারবেন, বাড়িটি অনুমোদিত কি না। যাচাই করার প্রক্রিয়াকে সহজ করার জন্য পুরসভার এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানোই যেত, যদি না মাথা তুলত অপর একটি প্রশ্ন— বোর্ডহীন নির্মাণ, অথবা ভুয়ো কোড-সম্বলিত নির্মাণগুলির কী হবে? সেগুলো কি বৈধতার সঙ্কেতহীন হয়েও প্রকাশ্যে আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকবে? অবৈধ নির্মাণ চিহ্নিত করেই তো পুরসভার কাজ শেষ হয়ে যায় না, সেগুলি নিশ্চিহ্ন করার দায়িত্বও পুরসভারই। বাস্তব চিত্র কী, তা অবশ্য শহরবাসীর জানতে বাকি নেই। ১৭ মার্চ ২০২৪ গার্ডেনরিচে একটি বাড়ি ধসে পড়ে তেরো জন প্রাণ হারানোর পরে দেখা গিয়েছিল, ওই এলাকায় এমন অবৈধ বাড়ি প্রচুর। এর পর পুরসভা বেআইনি নির্মাণগুলির বিদ্যুৎ, জল ও নিকাশির সংযোগ কাটার নির্দেশ দেয়, বেশ কিছু বেআইনি বাড়ির মালিকদের নোটিসও দেওয়া হয়। সে সব নির্দেশ কার্যকর করা যায়নি। উপরন্তু কলকাতার নানা এলাকায় একের পর এক বাড়ি হেলে পড়তে দেখা গিয়েছে বিপজ্জনক ভাবে। যার অর্থ, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক দুর্নীতি ও নিষ্ক্রিয়তা চলছেই। অবৈধ নির্মাণ ভাঙতে গিয়ে জনপ্রতিনিধিদের থেকেই বাধা পান পুরসভার ইঞ্জিনিয়াররা। এই পরিস্থিতিতে কিছু কিউআর কোড-সম্বলিত বোর্ড কতটুকু ভরসা ফেরাতে পারে পুরসভার সদিচ্ছার উপরে?
ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত তথ্যের নাগাল দিতে পারে, এবং সাধারণের আয়ত্তাধীন। তাই অনেক সময়েই প্রযুক্তির ব্যবহার পরিষেবায় তৎপরতা এবং স্বচ্ছতার বোধ তৈরি করে। কিন্তু শেষ অবধি উৎকোচ, স্বজনপোষণ, বিধিভঙ্গের মতো প্রশাসনিক সঙ্কটের সমাধান এবং সংস্কার প্রশাসনিক ভাবেই করা সম্ভব। প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়মানুবর্তিতা রাখতে সহায়তা করতে পারে তখনই, যখন প্রশাসন অনিয়ম চিহ্নিত করতে তার প্রয়োগ করে। প্রশাসন যদি অনিয়ম গোপন করতে চায়, তা হলে ডিজিটাল প্রযুক্তি কতটুকু স্বচ্ছতা দিতে পারে? নানা ধরনের সরকারি প্রকল্পের জন্য আবেদন, নথিভুক্তি এখন কেবল ডিজিটাল মাধ্যমেই হচ্ছে— তাতে ঘুষের অভিযোগ বিন্দুমাত্র কমেনি। প্রযুক্তি কেবল সরকারি প্রক্রিয়ার আরও একটি স্তর যোগ করছে। ‘বাংলার বাড়ি (গ্রামীণ)’ প্রকল্পের জন্য ‘ইউনিক ডকুমেন্ট আইডেন্টিফিকেশন নম্বর’ (ইউডিআইএন) চালু করার যে সিদ্ধান্ত সম্প্রতি নিয়েছে সরকার, সেই নীতি সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। পশ্চিমবঙ্গে আবাস যোজনায় ব্যাপক দুর্নীতি ঘটতে পেরেছিল প্রাপকের তালিকা তৈরিতে রাজনৈতিক চাপ এবং প্রশাসনিক শিথিলতার জন্য। যাঁরা প্রাপকদের তালিকা যাচাই করতে গিয়েছিলেন, সেই সরকারি কর্মীদের উপর যে ভাবে ভীতিপ্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, তার জেরে এক মহিলাকর্মী আত্মহত্যাও করেছিলেন। সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন যদি না হয়ে থাকে, তা হলে ‘ইউডিআইএন’ আরও একটি শর্ত হয়ে রয়ে যাবে। অপর যে কোনও শর্তের মতো, এই শর্তটিও পূরণ করতে পারবেন অযোগ্যরা, যোগ্যরা তার নাগাল পাবেন না।
একই ভাবে, ‘কিউআর কোড’-এর অবৈধ ব্যবহারের আশঙ্কাও থেকে যায়। আরও বড় চিন্তা তার অব্যবহার। অবৈধ বাড়ির একটি বাজার তৈরি হয়ে রয়েছে পুর এলাকাগুলিতে। বিক্রেতা এবং ক্রেতা, দু’তরফই সেই অবৈধতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। বৈধ নির্মাণের চেয়ে কিছু কম দামে সেখানে বিক্রি হয় জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট। জলাশয় বুজিয়ে, নির্মাণের পুরবিধি অগ্রাহ্য করে যে ভাবে বাড়িগুলি গঠিত হয়, তাতে অবৈধতা লুকানোর খুব বেশি চেষ্টা দেখা যায় না। এই দুর্নীতিচক্র ভাঙতে উদ্যোগী না হলে পুরসভার উপর ভরসা ফেরার সম্ভাবনা সামান্যই। তা চটজলদি প্রযুক্তির কাজ নয়। জনসংযোগের বাইরে গিয়ে প্রশাসনিক কাজ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)