এ যেন নাকের বদলে নরুন দেওয়া। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিয়োর’ প্রকাশ করেছে— জলাশয় বুজিয়ে তার পরিবর্তে একটি ক্ষতিপূরক জলাশয় বাধ্যতামূলক ভাবে তৈরির। জলাশয় ভরাটের আবেদন জমা পড়ার পর তৃণমূল স্তরে তদন্ত করে সেই নথি পাঠানো হবে পরিবেশ দফতরে। অনুমোদন মিললে আবেদনকারীকে বিকল্প জলাশয় তৈরির নির্দেশ দেওয়া হবে। নতুন জলাশয়ের ছবি-সহ প্রমাণ জমা দিলে ফের তদন্ত হবে। শেষে মাছ চাষ ও মৎস্য সম্পদ দফতর নতুন জলাশয় খতিয়ে দেখে অনুমোদন দিলে তবে আবেদনকারী অগ্রসর হতে পারবেন। নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, সেই সকল ধাপ পেরিয়ে আবেদনের নিষ্পত্তি করতে হবে সর্বোচ্চ ১২০ দিনের মধ্যেই। জলাশয় ভরাটের বিষয়ে বিভিন্ন সরকারি দফতরের সংযুক্তকরণ, একাধিক বার তদন্ত, নজরদারি— এ সবের গুরুত্ব যথেষ্ট। সরকারি দফতরগুলির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, প্রবল দুর্নীতি এবং উদাসীনতার পরিণতিতে কলকাতা ও সংলগ্ন জেলাগুলিতে অবৈধ ভাবে জলাশয় ভরাটের কাজ দুর্বার গতিতে এগিয়েছে, এবং বহু ক্ষেত্রে বিকল্প জলাশয় তৈরি না করেই তা সম্পন্ন হয়েছে।
প্রশ্ন হল, নতুন নিয়ম কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারবে কি না। জলাশয় শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট জলপূর্ণ ক্ষেত্র নয়, এক বৃহৎ অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র ও জীবনযাত্রাকে তা ধারণ করে রাখে। তাকে বুজিয়ে ফেলা মানে সেই বাস্তুতন্ত্রকেও ধ্বংস করা। অন্য দিকে, নতুন জলাশয়টির অনুরূপ বাস্তুতন্ত্র গড়ে তুলতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। সেই সুবিশাল ফাঁক পূরণ হবে কী করে? দু’বছর আগে কলকাতা হাই কোর্টও কার্যকারিতা পূরণের প্রশ্নটিই করেছিল রাজ্য সরকারকে, যার সরাসরি উত্তর মেলেনি। বিভিন্ন ঘটনাক্রমে প্রমাণিত, পরিবেশ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন দফতর প্রাথমিক পাঠটুকুও রপ্ত করতে পারেনি। নয়তো, পুকুর বোজানোর সঙ্গে প্রাকৃতিক অরণ্যকে উচ্ছেদ করে পরিকল্পিত বনভূমির সৃষ্টির একটি তুলনামূলক আলোচনা করতে পারত। এ দেশে ফরেস্ট সার্ভে অব ইন্ডিয়া-র প্রায় প্রতি রিপোর্টেই দেখানো হয়, অরণ্য আচ্ছাদন বৃদ্ধির কথা। কারণ, তাতে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট অরণ্যের সঙ্গে পরিকল্পিত বনভূমির পার্থক্যটি দেখানো হয় না। বাস্তবে, কৃষিজমির বিস্তার, নগরায়ণ, নদী উপত্যকার বিভিন্ন প্রকল্প, পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতির স্বার্থে প্রাকৃতিক অরণ্যকে ধ্বংস করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে দেশ জুড়ে। বিপন্ন হচ্ছে জীববৈচিত্র, অরণ্যের বাস্তুতন্ত্র। পরিকল্পিত বনভূমির সাধ্য কই সেই ক্ষতি পূরণের?
ক্ষতিপূরক জলাশয়ের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটিই হওয়ার সম্ভাবনা। খাতায়-কলমে জলাশয় হয়তো কম দেখানো হবে না, কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি ঠেকানো যাবে না। তা ছাড়া বিকল্প জলাশয়টি কোথায় তৈরি হবে, তার রক্ষণাবেক্ষণ কী রূপে হবে, সেই প্রশ্নগুলিও উপেক্ষণীয় নয়। যে গতিতে জলাশয় বোজানোর কাজ চলছে, বিকল্প জলাশয়ের নির্মাণ তাকে আদৌ ছুঁতে পারবে কি না, প্রশ্ন সেখানেও। যারা সাধারণ সময়ে আইন মানে না, এবং যারা দিনেদুপুরে আইন অমান্য দেখেও চোখ বুজেই থাকে, নতুন নিয়মে তারা সকল অনাচার পরিত্যাগ করে পরিবেশের কথা ভাববে, তেমনটিও কষ্টকল্পনামাত্র। বরং নতুন নিয়মকে ঢাল করে পুকুর চুরি আরও অবাধ হবে, সেই সম্ভাবনাই আপাতত প্রবল হয়ে উঠছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)