তেলঙ্গানার একটি ওষুধ তৈরির কারখানায় ৩০ জুন যে বিস্ফোরণ ঘটল, তা দেশের বৃহৎ শিল্প-দুর্ঘটনাগুলির মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। নিহতের সংখ্যা চল্লিশ ছাড়িয়েছে, আহত আরও বেশি, নিখোঁজ অনেক। বিস্ফোরণের পর মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডি ওই কারখানাটি পরিদর্শন করেছেন; নিহতের পরিবার ও আহত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ ঘোষিত হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কমিটিও গঠন করেছে রাজ্য সরকার। প্রশ্ন হল, অতীতে শিল্প-দুর্ঘটনাগুলির তদন্তে কলকারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অবহেলা, গাফিলতির যে কারণগুলি উঠে এসেছে, তা থেকে কী শিক্ষা আহরণ করেছে শিল্প, প্রশাসন? চার দশক আগে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ শিল্প-দুর্ঘটনা ঘটেছিল ভারতেই— ভোপালের ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানায়। তা সত্ত্বেও আজ শিল্পক্ষেত্রে নিরাপত্তার নিরিখে ভারত সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশের অন্যতম। একটি অসরকারি সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছর ভারতে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার সংখ্যা দু’শোটিরও বেশি, যাতে চারশোরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, অন্তত ৮৫০ আহত হয়েছেন। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলেই অনুমান, কারণ কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাগুলি সাধারণত নথিভুক্ত হয় না। রাসায়নিক এবং ওষুধ কারাখানাগুলি বিশেষ ভাবে দুর্ঘটনা-প্রবণ। গত বছর এই শিল্পক্ষেত্রে একশোটিরও বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে, নিহত হয়েছেন অন্তত ৫৫০ জন। মে মাসে মুম্বইতে একটি রাসায়নিক কারখানার বিস্ফোরণ, এবং অগস্টে অন্ধ্রপ্রদেশের একটি ওষুধ কারখানায় বিস্ফোরণ তার নিদর্শন। সংবাদে প্রকাশ, নানা রাসায়নিকের সংরক্ষণ বা মিশ্রণে যথাযথ সতর্কতার অভাব-সহ নানা ধরনের ত্রুটি ছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থায়।
কেবল তেলঙ্গানাতেই গত ৩০ মাসে নানা শিল্পতালুকে ১০টি গুরুতর বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে যে রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটি এবং যন্ত্রচালনায় দক্ষ কর্মীর অভাব দুর্ঘটনার মূল কারণ। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গিয়েছে, একটি ‘স্প্রে-ড্রাইং’ মেশিনের মধ্যে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হওয়ার ফলে বিস্ফোরণ হয়। সম্ভবত তার কারণ, ওই মেশিনের তাপ-নিয়ন্ত্রণকারী ‘ব্লো এয়ার হ্যান্ডলার’ যন্ত্রটির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। অতিরিক্ত তাপ বাড়ার ফলে গ্যাসের প্রচণ্ড চাপে ভয়ানক বিস্ফোরণ ঘটে। নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে যায় তিনতলা একটি বাড়ি, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় কর্মরত শ্রমিকদের শরীর। কারখানায় নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবই আপাতদৃষ্টিতে দায়ী। সরকার-নিযুক্ত কমিটির তদন্তের ফল হয়তো প্রকাশিত হবে যথাসময়ে। কিন্তু অতীতে নানা শিল্পে দুর্ঘটনাগুলির তদন্তে বার বার যে সমস্যাগুলি উঠে এসেছে— নিরাপত্তা বিধি মানার বিষয়ে অবহেলা, তত্ত্বাবধান ব্যবস্থার দুর্বলতা, কারখানা পরিদর্শন ব্যবস্থার ত্রুটি, বিপজ্জনক কাজে বড় সংখ্যক অপ্রশিক্ষিত কর্মীদের নিয়োগ— সেগুলির নিরসনে কী করা হয়েছে?
এই যখন পরিস্থিতি, তখন নয়া শ্রম বিধি নিরাপত্তার তত্ত্বাবধান ব্যবস্থাকে আরও শিথিল করে তুলছে। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিধি (অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ ওয়ার্কিং কন্ডিশন কোড) হঠাৎ-পরিদর্শনের প্রথাটি রদ করেছে। কর্তৃপক্ষকে আগাম না জানিয়ে পরিদর্শন করতে পারবেন না শ্রম আধিকারিকরা। নিরাপত্তায় কোনও ত্রুটি পাওয়া গেলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করার ক্ষমতাও লাঘব করা হয়েছে। এ ছাড়াও সুরক্ষা বিধি থেকে যে কোনও কারখানাকে ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে প্রশাসনকে। ভারতে কর্মক্ষেত্রে ধারাবাহিক দুর্ঘটনার যে উদ্বেগজনক চিত্র সামনে আসছে, তার নিরিখে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শ্রম বিধির এই শিথিলতা একেবারেই স্বস্তিদায়ক নয়। কটু সত্যটি এই যে, কেবল বড় বড় দুর্ঘটনার পরেই নিরাপত্তা নিয়ে কোনও রকম আলোচনা হয়। অতঃপর চলে নিষ্ক্রিয়তা, যত দিন না ফের দগ্ধ, ছিন্নভিন্ন, শ্বাসরুদ্ধ দেহগুলি কারখানা চত্বর থেকে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)