E-Paper

কার দোষ

রেল কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা, মহিলা নিত্যযাত্রীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। তাই তাঁদের নিরাপত্তার খাতিরে ট্রেনের প্রান্তভাগের কামরাগুলিতেই মহিলাদের বরাদ্দ স্থান বাড়ানো হয়েছে।

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫ ০৪:৩০

একের পর এক স্টেশনে দাঁড়িয়ে ট্রেন। লাইনের উপর ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে রোষ দেখাচ্ছেন যাত্রীরা। বৈশাখী সূর্যের উত্তাপকে হারিয়ে দিতে পারে তাঁদের মেজাজের পারদ। ফলে, বেশ কয়েকটি ট্রেন বাতিল, মাঝসপ্তাহের ব্যস্ত অফিস-সময়ে পণ্ড রেলের স্বাভাবিক সময়-সারণি। পরিবহণ পরিষেবাকে থমকে দিয়ে, সাধারণ মানুষকে নাকাল করে রেল অবরোধের চেনা ছবি দিয়েই শুরু হল বাঙালির নতুন বছর। গত সপ্তাহের মঙ্গলবার থেকেই ধিকি-ধিকি আঁচ জ্বলছিল, বুধ-বৃহস্পতি দফায়-দফায় অবরোধ চলল শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার একাধিক স্টেশনে। যাত্রী-বিক্ষোভের জেরে শিয়ালদহ-লক্ষীকান্তপুরের পুরো শাখাটিতে ট্রেন-চলাচল দীর্ঘ ক্ষণ বিপর্যস্ত হয়ে রইল। অবরোধকারীদের উষ্মার কারণ, লোকাল ট্রেনে মহিলা-কামরার সংখ্যা দুই থেকে তিন করা হয়েছে, এতে পুরুষ-যাত্রীদের পরিসর কমেছে, ভিড়ের সময় ওঁদের ভোগান্তি বেড়েছে।

রেল কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা, মহিলা নিত্যযাত্রীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। তাই তাঁদের নিরাপত্তার খাতিরে ট্রেনের প্রান্তভাগের কামরাগুলিতেই মহিলাদের বরাদ্দ স্থান বাড়ানো হয়েছে। স্টেশনে দ্রুত ওঠা-নামার জন্য, ওই নির্দিষ্ট কামরাগুলো বহু পুরুষ-যাত্রীরও পছন্দ। অন্য কামরায় উঠতে তাঁদের অনীহা। উদ্বেগের বিষয়, পুরুষদের কাছে যা শুধুই স্বাচ্ছন্দ্যের প্রশ্ন, মহিলাবৃত্তে সেটিই হয়ে দাঁড়াচ্ছে সুরক্ষা সংক্রান্ত অপরিহার্য পদক্ষেপ। মেয়েদের জন্য গণপরিবহণের এই নিরাপত্তা কতখানি প্রয়োজনীয়— কারও অজানা নয়। যাত্রাপথে যৌন ও মৌখিক হেনস্থা, অবাঞ্ছিত স্পর্শ বা আচরণ টপকে তবে তাঁরা কর্মক্ষেত্রে পৌঁছন। অভিসন্ধিমূলক আগ্রাসনই নয়, বহু পুরুষই গণপরিসরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জায়গা দখল করে নেন, মেয়েদের সঙ্কুচিত থাকার সেও বড় কারণ।

মহিলা-কামরা নিয়ে অসন্তোষেও সেই অদ্ভুত প্রবৃত্তির লক্ষণ। ভিড়ে ভোগান্তি হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে ব্যস্ত সময়ে ট্রেনের ব্যবধান কমানো এবং ট্রেন ও কামরা বাড়ানোর দাবি তোলাই যুক্তিগ্রাহ্য। তাকে গৌণ রেখে মেয়েদের স্বস্তির ব্যবস্থাটুকুতে আপত্তি তুললে তো নারীবিদ্বেষই পরিস্ফুট হয় বেশি। পরে মাতৃভূমি লোকাল-এর কিছু কামরায় পুরুষদের প্রবেশাধিকার দিয়ে ও কিছু ট্রেনে আরও কামরা সংযোজনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন রেল কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ, তাঁরা সাধারণ যাত্রীদের চাহিদা এবং ফাঁকা থেকে যাওয়া কামরাগুলির পূর্ণ সদ্ব্যবহারের দিকগুলিও বিবেচনা করছেন। নিরাপত্তার বিষয়টিও তাঁদের সদিচ্ছা-প্রসূতই। কিন্তু, ভাবনা ও বাস্তবায়নের মধ্যে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনায় ফাঁক থেকে যাওয়াতেই এত ঝঞ্ঝাট। ঠিক কোন কামরাগুলি মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট হল, তা দৃষ্টিগোচর ভাবে চিহ্নিত বা রং করে আগেভাগে প্রচার, প্ল্যাটফর্মে মাইকিং করলে হঠাৎ এত বিশৃঙ্খলা হত না। মূল সমস্যা যে-হেতু স্থান অসঙ্কুলানের, সংরক্ষিত কামরা বাড়ানোর বদলে ট্রেন ও কামরা বাড়িয়ে দেওয়াটাই ছিল তার সোজা সমাধান। মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ কিন্তু দেশ ও জাতির পক্ষে অসম্মানজনক। তা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে, এখানে লিঙ্গ-হিংসা এতটাই বিপজ্জনক নারী-নিরাপত্তার জন্য আলাদা পরিকাঠামোকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। শেষ অবধি যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কিছু পুরুষের মধ্যে ভদ্রতা ও সৌজন্যের অভাবের কারণেই মহিলাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। আর সেই ব্যবস্থা নিয়ে যাঁদের এত অভিযোগ, তাঁরাও অধিকাংশ পুরুষ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Indian Railways Indian Railway

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy