সংসদে একটি প্রশ্নের উত্তরের সূত্র ধরে নতুন করে চাকা আবিষ্কার করেছেন বঙ্গ বিজেপির এক সাংসদ। তাঁর প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে ২২২৭টি সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাদের দফতর সরিয়ে নিয়েছে। তার মধ্যে ৩৯টি সংস্থা শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত ছিল। এই তথ্য থেকে বিজেপির সাংসদ জানিয়েছেন যে, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের পরিবেশ নেই। তা যে নেই, সে কথাটি নতুন করে বলার প্রয়োজন ছিল না— রাজ্যবাসী কথাটি হাড়ে-হাড়ে জানেন। তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি সেই শিল্পহীনতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। কিন্তু, রাজ্য থেকে শিল্পসংস্থার বিদায়, বা তাদের সদর দফতর অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যদি শুধুমাত্র বর্তমান সরকার ও প্রশাসনকেই দায়ী করা হয়, তাতে রাজনীতি হয় বটে, সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা যায় না। ঘটনা হল, পশ্চিমবঙ্গের ক্রম-শিল্পহীনতার দায় সব গোত্রের রাজনীতির উপরে বর্তায়। এবং, ইতিহাসের উপরেও। দেশভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গ ছিল ভারতের সর্বাপেক্ষা শিল্পোন্নত রাজ্য। সাংবাদিক রণজিৎ রায়ের অ্যাগনি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল নামক বইটি সে রাজ্যের পতনের ধারাবিবরণী রচনা করেছিল— বর্তমান রাজনীতিকরা এক বার বইটির পাতা উল্টে দেখে নিতে পারেন। তার প্রথম ধাক্কাটি ছিল দেশভাগ। এক দিকে বিপুল উদ্বাস্তু সমস্যা এবং তার সমাধানে কেন্দ্রীয় সরকারের দায়সারা মনোভাব, এবং অন্য দিকে রাজ্যের প্রধানতম শিল্প চটের কাঁচামাল অর্থাৎ পাটের জোগান বন্ধ হয়ে যাওয়া— সেই জোড়া ধাক্কা এই রাজ্যটি সামলাতে পারেনি।
কিন্তু, সেটুকুই সমস্যা ছিল না। ঔপনিবেশিক আমলে বাংলায় মূলত বিদেশি পুঁজির লগ্নি ছিল। যা চরিত্রে ছিল বিনিয়োগ-পুঁজি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সে পুঁজি ক্রমে বাংলা ছাড়ে। লগ্নির হস্তান্তর হয় যে ভারতীয় জনগোষ্ঠীর হাতে, তাদের পুঁজি ঐতিহাসিক ভাবেই চরিত্রে বাণিজ্য-পুঁজি। সে পুঁজির মেয়াদচক্র বিনিয়োগ-পুঁজির চেয়ে কম সময়ের। ফলে, দ্রুত মুনাফা অর্জনের চাপ পড়ে বাংলার শিল্প সম্ভাবনায়— পুঁজির টান পড়তে থাকে। তাতে তৈরি হয় শ্রমিক অশান্তি, এবং তার সম্পূর্ণ ফয়দা তোলে দায়িত্বজ্ঞানহীন বামপন্থী রাজনীতি। পুরনো সংবাদপত্রের পাতা উল্টোলে জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতির যে সব নিদর্শন মিলবে, তা কোনও সভ্য দেশে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পুঁজির হস্তান্তরের কারণে শিল্পক্ষেত্রে তৈরি হওয়া অস্থিরতার সমাধানসূত্র বার করার পরিবর্তে সেই শ্রমিক আন্দোলন শিল্পমেধ যজ্ঞে নামে। তাতে রাজনৈতিক লাভ হয়েছিল বিলক্ষণ, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ শিল্পশ্মশানে পরিণত হয়।
অন্য দিকে ছিল দিল্লির নেহরু সরকার। রেলের মাসুল সমীকরণ নীতির ফলে প্রাকৃতিক সম্পদে ঋদ্ধ পূর্ব ভারত তার সুবিধা হারায়। পশ্চিমবঙ্গের অর্থব্যবস্থায় তার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। কিন্তু, শুধুমাত্র এটুকুই নয়, তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার তার শিল্প ও বাণিজ্য পরিকল্পনাকে ক্রমেই দিল্লি ও উত্তর-পশ্চিম ভারতমুখী করে তোলে। তার ফলে বিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গ থেকে কর্পোরেট পুঁজির নিষ্ক্রমণ ঘটতে থাকে। শিল্পের একটি বাস্তুতন্ত্র আছে। যেখানে সরকারি দফতর, যেখানে আর পাঁচটা সংস্থার ভিড়, সেখানেই সমস্ত সংস্থা তার দফতর গড়তে চায়। শুধু ভারতে নয়, কথাটি সব রাজ্যের জন্যই সত্য। কলকাতা থেকে শিল্পের মহানিষ্ক্রমণ নিশ্চিত করল যে, অন্য সংস্থাগুলিও এই শহর ছাড়তে মরিয়া হবে। শুধুমাত্র অতীত কেন, বর্তমানেও সেই একই ঘটনা ঘটে চলেছে। বিজেপির সাংসদের হয়তো মনে পড়তে পারে যে, ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া এবং এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের সদর দফতর কলকাতায় ছিল। ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের মোড়কে কলকাতা থেকে সে দু’টি ব্যবসাও বিদায় নিয়েছে, নরেন্দ্র মোদীর আমলেই। পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে তাঁরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে স্থান দিলে এ বিষয়েও দু’চারটি কথা বলে দেখতে পারেন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)