Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Prime Minister

নকলনবিশি

গুজরাতে ঐক্যমূর্তির প্রথম তলে পটেলের জীবন ও কর্ম ইত্যাদি লইয়া অডিয়োভিসুয়াল প্রদর্শনীর বন্দোবস্ত রহিয়াছে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:৪৪
Share: Save:

চিনের মূর্তি আমাদের মূর্তি! সম্প্রতি হায়দরাবাদের নিকটে বৈষ্ণব সন্ন্যাসী ত্রিদণ্ডী চিন্না জিয়ার আশ্রমে ২১৬ ফুট উঁচু রামানুজাচার্যের মূর্তি উদ্বোধন করিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী। উপবিষ্ট অবস্থায় ইহা দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মূর্তি, উচ্চতায় তাইল্যান্ডের বুদ্ধমূর্তির পরেই। ইহার নাম দেওয়া হইয়াছে স্ট্যাচু অব ইকুয়ালিটি বা সমতামূর্তি। ১৩৫ কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র, লৌহ ও সিসা, এই পঞ্চধাতু নির্মিত বিশালকায় মূর্তিটি ১৬০০ খণ্ডে চিনের অ্যারোসান সংস্থা নির্মাণ করে, অতঃপর উহা ভারতে প্রেরিত হয়। রামানুজাচার্যের সহস্রতম বর্ষে উহা ভক্তদিগের শ্রদ্ধার্ঘ্য। মূর্তিরসজ্ঞদের কয়েক মাস আগে সর্দার সরোবর বাঁধে নির্মিত, ৫৯৭ ফুট উঁচু সর্দার বল্লভভাই পটেলের মূর্তির কথা মনে পড়িতে পারে। দুনিয়ার বৃহত্তম মূর্তি, কিন্তু এই আত্মনির্ভর দেশে বৃহৎ ব্রোঞ্জ ঢালাইয়ের যথাযথ পরিকাঠামো নাই বলিয়া সেই মিশ্র ধাতুর প্যানেলগুলি তৈরির জন্য চিনা সংস্থাকে বরাত দেওয়া হইয়াছিল। শিল্পের পরিসরে চিন বনাম ভারত দ্বন্দ্ব চলে না। যেখানে যথাযথ শিল্পনৈপুণ্যে মূর্তির প্রাণপ্রতিষ্ঠা হইবে, তাহা খুঁজিয়া বার করাই একমাত্র জরুরি।

শৈল্পিক সুষমার কারণে উঁচু মূর্তির ভিত্তিভূমিও উচ্চ হয়। গুজরাতে ঐক্যমূর্তির প্রথম তলে পটেলের জীবন ও কর্ম ইত্যাদি লইয়া অডিয়োভিসুয়াল প্রদর্শনীর বন্দোবস্ত রহিয়াছে। হায়দরাবাদে সমতামূর্তির প্রথম তলেও তদ্রূপ। চলচ্ছবিতে হাজার বৎসর পূর্বের বৈষ্ণব সাধকের জীবন ও কর্মের আয়োজন। দুর্জনে প্রশ্ন তুলিতে পারে, এই কর্মযজ্ঞের আয়োজন তেলঙ্গানায় না করিয়া তামিলনাড়ুর পেরুমপুদুরে, রামানুজাচার্যের জন্মস্থানে হইল না কেন? পৃষ্ঠপোষক চিন্না জিয়া বলিয়াছেন, তাঁহার প্রাথমিক পরিকল্পনা তামিলনাড়ুতেই ছিল। কিন্তু তথায় পাহাড় কাটিয়া বিশালকায় মন্দির নির্মাণের উপযোগী ভূপ্রকৃতি ছিল না। না থাকুক, তামিলনাড়ুর আয়েঙ্গার ব্রাহ্মণরা আজও নিজেদের রামানুজ প্রবর্তিত শ্রীসম্প্রদায়ের উত্তরসূরি মনে করেন। বৃন্দাবনে সোনার তালগাছ ও তৎসংলগ্ন মন্দিরটিও শ্রীসম্প্রদায়ের। শ্রীচৈতন্যের দক্ষিণ ভারত পর্যটনের কথাও মনে পড়িতে পারে। আমাদের মহাপ্রভুর প্রায় পাঁচশত বৎসর আগে এই তামিল সাধকের জন্ম, আজও তিনি জাতপাতের বিরুদ্ধে মানবপ্রেমের জীবন্ত বিগ্রহ। কিংবদন্তি, বিষ্ণুভক্ত গুরু মহাপূর্ণাচার্য শিষ্য রামানুজকে গুহ্যাতিগুহ্য অষ্টাক্ষরী মন্ত্র দান করেন। অতঃপর শপথ করাইয়া নেন, রামানুজ এই মন্ত্র দ্বিতীয় কাহাকেও বলিবেন না। কারণ মহাপাপীও এই মন্ত্রপাঠে উদ্ধার পাইবে। মন্ত্রপ্রাপ্ত রামানুজ কিন্তু দর্শন করিলেন অন্য দৃশ্য— সংসারদুঃখে দীর্ণ সহস্র নরনারী। তিনি এক বিষ্ণুমন্দির হইতে উচ্চৈঃস্বরে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে শুনাইয়া দিলেন সেই মহামন্ত্র। গুরুর ভর্ৎসনায় অবাধ্য শিষ্য কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, তিনি একা নরকযন্ত্রণা ভোগ করিলে যদি এত লোক উদ্ধার পায়, তিনি সানন্দে রাজি। মন্দিরশীর্ষেই তো তাই জাতপাতের বেড়া ভাঙিয়া দেওয়া সাধকের মূর্তি বসিবে।

কিন্তু কিংবদন্তি ভিন্ন, তাহাতে রামানুজের কৃতিত্ব সিকিভাগও বুঝা যায় না। রামানুজ অদ্বৈতবাদী, কিন্তু ভক্ত। শঙ্করাচার্যও অদ্বৈতবাদী, কিন্তু এই জগৎ ও জীবনে তিনি ভ্রমাত্মক মায়ার আচ্ছাদন অনুভব করেন। মায়ার আবরণের কারণেই তো রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়, তুচ্ছ ঝিনুক বা শুক্তিকে মুক্তা বলিয়া বোধ হয়। আমার বাড়ি, আমার গাড়ি, আমার স্ত্রী, আমার সন্তান সবই এই মায়ার ভ্রম। শঙ্কর মনে করেন, একমাত্র নির্গুণ ব্রহ্মই মায়া হইতে মুক্ত। পক্ষান্তরে রামানুজ মনে করেন, ব্রহ্ম সগুণ। তাঁহার সুখ দুঃখের লীলা আছে। রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ এখানেই শঙ্করের মায়াবাদ হইতে পৃথক। সে জগৎকে স্বীকার করে, ভক্তের সহিত ভগবানের মায়ার লীলা আস্বাদ করে। রামানুজের ভক্তিবাদ তাই কাশ্মীর হইতে কন্যাকুমারিকা অবধি আজও সতত ক্রিয়াশীল। পটেলের সহিত জাতীয় সংহতি, জাতীয় ঐক্যের সম্পর্কটি তবু বোধগম্য। কিন্তু রামানুজ-মূর্তিকে কেন নিউ ইয়র্কের স্ট্যাচু অব লিবার্টির নকলনবিশি করিয়া স্ট্যাচু অব ইকুয়ালিটি বলিতে হইবে? রামানুজের প্রথম পরিচিতি ভক্তিই কেন নামাঙ্কনে থাকিবে না? সাম্য এবং ভক্তি এক নহে। রুশো, ভলতেয়ার এবং ফরাসি বিপ্লব সাম্যের কথা বলিয়াছিল। ভক্তিবাদের সহিত সম্পর্ক ছিল না। শেক্সপিয়র যাহাই বলিয়া থাকুন, নামে অনেক কিছু আসে যায়। কে সেই কথা মনে রাখিবে? ব্যুৎপত্তিবিহীন, ধর্মহীন শব্দের প্রয়োগই আজিকার ভারতীয় রাজনীতির দস্তুর!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Prime Minister Narendra Modi Vaishnava movement
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE