E-Paper

ঐক্য-শিক্ষা

মূল কথাটি হল: পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সাহচর্য, ভাবধারার আদান-প্রদান শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠনকেই সম্পূর্ণ করে না, এক সুস্থ সমাজ গঠনের পক্ষেও তা সহায়ক।

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৪৪

বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য— একদা ভারতবর্ষের এই পরিচয়ই বাকি বিশ্বের সামনে তুলে ধরত তার গর্বিত নাগরিকরা। বিবিধ সম্প্রদায়, ধর্ম, ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাসের সন্ধান মিলত এই মহামানবের সাগরতীরে। সেই বৈচিত্র এখনও অমলিন, কিন্তু রাজনীতির কুচক্রে ‘ঐক্য’-এর অস্তিত্বটি আজ বড় বিপন্ন। চিহ্নটি যাতে একেবারে মুছে না যায়, সে জন্য কিছু ক্ষুদ্র প্রয়াস অবশ্য এখনও দেখা যায়। যেমন, কলকাতার বেশ কিছু স্কুল সচেতন ভাবে তাদের শ্রেণিকক্ষগুলিতে এক মিলনক্ষেত্র প্রস্তুত করতে উদ্যোগী হয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়, ধর্মের ছাত্রছাত্রীদের প্রবেশ অবাধ হয়েছে, যাতে ‘অন্য’ সংস্কৃতি, রীতি-নীতির বিষয়ে বাল্যকাল থেকেই এক শ্রদ্ধার ভাব ছেলেমেয়েদের মধ্যে গড়ে উঠতে পারে। কিছু স্কুল এক-একটি শ্রেণিকক্ষকে সাজিয়েছে এমন ভাবে, যাতে বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে আসা শিক্ষার্থীরা একত্রে ক্লাস করতে পারে। কিছু স্কুল আবার ধর্ম, সম্প্রদায়ের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রয়োজন, পাঠগ্রহণের ক্ষমতাকেও মেলাতে চেয়েছে। মূল কথাটি হল: পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সাহচর্য, ভাবধারার আদান-প্রদান শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠনকেই সম্পূর্ণ করে না, এক সুস্থ সমাজ গঠনের পক্ষেও তা সহায়ক।

উদ্যোগটি প্রশংসার্হ। কিন্তু হতাশার সুরটিকে তা পুরোপুরি ঢাকা দিতে পারে না। হতাশা, যা কিছু নিতান্ত সহজ স্বাভাবিক, তাকে প্রতিষ্ঠার ‘চেষ্টা’ করতে হচ্ছে। কিছু দশক আগেও এই বঙ্গে সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়, ধর্ম, আর্থ-সামাজিক অবস্থান থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীরা একত্রে পাঠগ্রহণ করত। স্কুলগুলির সেই পরিচালন-পদ্ধতিতে নানা ক্ষেত্রে হয়তো অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল, কিন্তু সরস্বতী পুজো, ইদ, কিংবা বড়দিনের আনন্দ ভাগ করে নিতে কোনও বাধার প্রাচীর শিক্ষার্থীদের সামনে তোলা হত না। এখন হয়, কারণ সাম্প্রতিক কালে সমাজে নিয়মিত তার চর্চা চলে। ‘এক’ হওয়ার তাড়নায় ‘অনেক’-এর মাহাত্ম্য এখন বিস্মৃতপ্রায়। তাই, সমাজের ছোট ছোট পরিসরে, তথাকথিত শিক্ষিত এবং উদারমনস্কদের মধ্যেও, ধর্ম, সম্প্রদায়, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বিভেদের অনুশীলন চলে অবিরাম। তুচ্ছ কারণে পারস্পরিক হিংসা, বিদ্বেষ প্রদর্শন প্রতি দিনের যাপনে এখন স্বাভাবিক। সেই বিষ থেকে শিশুরা মুক্ত থাকবে কোন উপায়ে? এর পরিপ্রেক্ষিতেই বিদ্যালয়গুলির এ-হেন পদক্ষেপের গুরুত্ব বোঝা যায়।

কিন্তু এখনও অনেক পথ চলা বাকি। এই উদ্যোগ কিছু সংখ্যক বিদ্যালয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অপর-এর সঙ্গে সম্মিলনের ধারণা সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখনও আত্মস্থ করে উঠতে পারেনি। এমনকি দেশের প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও হামেশাই তার প্রকাশ দেখা যায়। ভাষা, ধর্ম, সম্প্রদায়ের পাশাপাশি শারীরিক বা মানসিক দুর্বলতাকে চিহ্নিত করেও প্রতিনিয়ত অকারণ হেনস্থার সম্মুখীন হয় অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। এবং সে-ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষও চরম অসহযোগিতার পরিচয় রাখেন। মাঝপথে পাঠছুট, অসুস্থ হয়ে পড়া, এমনকি আত্মহননের কারণগুলি বিশ্লেষণ করলেও দেখা যাবে তাদের মধ্যে এক লক্ষণীয় সংখ্যক শিক্ষার্থীই নানা ভাবে এই বিদ্বেষ-বিষের শিকার। এই মানসিকতাকে সর্বাগ্রে বর্জন জরুরি। ‘মিলাবে মিলিবে’র শিক্ষাটি হাতেগোনা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আবদ্ধ থাকলে চলবে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Education Unity humanity Schools Students

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy