অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে ময়না তদন্তের মাধ্যমেই মৃত্যুর কারণ, ধরন, সময় প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে অবগত হন তদন্তকারীরা। অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে এই প্রতিটি বিষয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অথচ, এই ক্ষেত্রটি পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরেই চূড়ান্ত অবহেলার শিকার। গত বছরের অগস্টে আর জি কর কাণ্ডে ময়না তদন্তের পদ্ধতিগত নানা অসঙ্গতি নিয়ে বিস্তর অভিযোগ উঠেছিল। অতঃপর চিকিৎসক-পড়ুয়ার ধর্ষণ-হত্যার সুবিচারের দাবির পাশাপাশি আর জি কর আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সরকারি হাসপাতালে মর্গের বিভিন্ন দুর্নীতি ও বেনিয়ম প্রকাশ্যে আনা। তবে, নিঃসন্দেহে ময়না তদন্ত সংক্রান্ত অভিযোগগুলি মান্যতা পায়, যখন উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিও তাঁর বক্তব্যে ত্রুটিবিচ্যুতিগুলির উল্লেখ করেন। বোঝা যায়, এ সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং অন্যায় এবং অবহেলার শিকড়টি অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে। সম্প্রতি ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস’-এ এক অনুষ্ঠানে কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ জানিয়েছেন, একই দেহে দ্বিতীয় বার ময়না তদন্তের আদেশ দেওয়া হলে দেখা যায় দুই ভিন্ন রিপোর্ট। তার একটিতে বলা হয়, আঘাতের চিহ্ন উপস্থিত, অন্যটিতে বলা হয় কিছুই নেই। তাঁর মতে, বিষয়টি শেষ পর্যন্ত চার্জশিটের প্রকৃতি এবং চরিত্রকে পরিবর্তিত করতে পারে।
ময়না তদন্তে গাফিলতির নজির কলকাতা থেকে জেলা, সর্বত্র। পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরিতে জোড়া মৃত্যুর দ্বিতীয় ময়না তদন্তের রিপোর্ট নিয়ে বিস্মিত হতে দেখা গিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্টকে। প্রথম রিপোর্টটিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর কথা বলা হলেও দ্বিতীয় রিপোর্টটিতে দেহে আঘাতের চিহ্নের কথা বলা হয়েছিল। মাননীয় বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছিলেন— জেলার ফরেন্সিক আধিকারিকেরা কি অভিজ্ঞ নন, না কি তাঁদের স্থানীয় ব্যক্তিদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে? খাস কলকাতার সরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, এক জন ডোমের উপর ভরসা করে দিনের পর দিন ময়না তদন্তের রিপোর্ট লিখেছেন এক সিনিয়র চিকিৎসক। জেলা হাসপাতালের অবস্থা করুণতর। কোথাও ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ ছাড়াই কোনও রকমে চালানো হচ্ছে ময়না তদন্তের কাজ, কোথাও ময়না তদন্ত ‘জটিল’ মনে হলে চিকিৎসকরা ঝুঁকি না নিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন দূরের সরকারি হাসপাতালে।
গাফিলতির নজির শুধুমাত্র ময়না তদন্তেই আটকে নেই। এক ধর্ষণের মামলায় ফরেন্সিক রিপোর্ট তৈরির পর তা আদালতে পেশ করতেই সাত বছর কাটিয়ে দিয়েছে বাগুইআটি থানার পুলিশ। কোনও অপরাধস্থলে ফরেন্সিক তদন্তকারী দল পৌঁছচ্ছে ঘটনা ঘটে যাওয়ার পাঁচ-সাত দিন পরে, কোথাও দিন পনেরো পরে। অথচ, দ্রুত কাজের জন্য ‘কুইক রেসপন্স টিম’, ‘মোবাইল ফরেন্সিক ইউনিট’, ‘ক্রাইম সিন ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন’ তৈরি-সহ একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথা নানা সময়ে শোনানো হয়েছে। বাস্তবে প্রায় সবটাই অকেজো। প্রশ্ন উঠলেই পরিকাঠামো, লোকবলের অভাবের অজুহাত শোনা যায়। ধর্ষণ-বিরোধী আন্দোলনের চাপে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার তদন্তের সময়সীমা বেঁধে দিতে তৎপর হয়েছে। কিন্তু ফরেন্সিক রিপোর্ট যদি যথাসময়ে না আসে, তা যদি ত্রুটিহীন না হয়, তবে সবই শেষ পর্যন্ত প্রহসনে পরিণত হয় না কি?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)