পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের নতুন সভাপতি প্রাপ্তির সংবাদ সামাজিক আলোচনার পরিসরে কোনও প্রতিধ্বনি তোলেনি। নিথর আশ্বিনের স্তব্ধ জলাশয়ে একটি ছোট্ট পাথরের টুকরো পড়লে যেটুকু তরঙ্গের সৃষ্টি হয়, অধীর চৌধুরীর উত্তরসূরি হিসাবে শুভঙ্কর সরকারের আবির্ভাবে তা-ও ঘটেনি। রাজ্যের নির্বাচনী মানচিত্রে আক্ষরিক অর্থে কোণঠাসা একটি দলের নেতৃপদে মোটের উপর অপরিচিত এক রাজনীতিক অধিষ্ঠিত হলে স্বাভাবিক অবস্থায় বিশেষ কোনও আগ্রহ সঞ্চারের কারণ থাকে না। তবে কিনা, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ‘স্বাভাবিক’ বলার কোনও উপায় নেই। কয়েক বছর ধরেই সরকার তথা শাসক দলের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির ব্যাপক প্রসার নিয়ে রাজ্য রাজনীতি ক্রমাগত উত্তাল হয়েছে, সম্প্রতি যে আলোড়নে এক অভূতপূর্ব মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, বিশেষত রাজ্যের ‘প্রধান’ বিরোধী দলের চরিত্র এবং আচরণের অন্তর্নিহিত সমস্যাবলির কারণে, রাজনীতির ময়দানে নতুন জমি তৈরি হচ্ছে, দেখা দিয়েছে শাসকের অনাচারের বিরুদ্ধে নতুন প্রতিস্পর্ধা সংগঠনের সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনা কংগ্রেসের ভূমিকাকে বিশেষ তাৎপর্য দিতে পারে। দলীয় নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিক রদবদলের ঘটনাটি সেই প্রেক্ষাপটে বিচার করা দরকার।
প্রেক্ষাপটটি জটিল। রাজ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে নাগরিক সমাজের প্রতিবাদী জাগরণের সঙ্গে সঙ্গেই উঠে এসেছে সামাজিক আন্দোলন থেকে দলীয় রাজনীতিকে তফাতে রাখার প্রশ্ন। লক্ষণীয়, বিরোধী রাজনীতির প্রধান দু’টি অংশের সম্পর্কেই প্রতিবাদী নাগরিকদের অনেকের প্রবল আপত্তি। প্রধান বিরোধী দলটির প্রতি বিরাগের প্রত্যক্ষ কারণ নিহিত আছে তাদের বিভাজনী এবং অসহিষ্ণু মতাদর্শে, যে মত প্রতিফলিত হয়ে চলেছে এক দিকে কেন্দ্রীয় শাসক দল হিসাবে তাদের ভূমিকায়, অন্য দিকে রাজ্য নেতাদের আচরণে। বামপন্থী দলগুলি সম্পর্কে সামাজিক বিরাগের পিছনেও তাদের মতাদর্শের আংশিক ভূমিকা আছে, কিন্তু সেই বিরাগের অনেক বড় কারণ তাদের সাড়ে তিন দশকের নিরবচ্ছিন্ন শাসনপর্বের স্মৃতি, এক যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও সমাজের মনে যার প্রভাব বিস্তর। ভিন্ন ভিন্ন কারণে হলেও, এই দুই শক্তি সম্পর্কে প্রতিবাদী নাগরিকদের একটি বড় অংশের এই আপত্তি রাজ্যের বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে সামাজিক আন্দোলনের স্বাস্থ্যকর সংযোগের পথে একটি গুরুতর বাধা।
এখানেই কংগ্রেসের একটি কার্যকর ভূমিকা সম্ভবপর। প্রথমত, রাজ্য রাজনীতিতে এই দলের সুদীর্ঘ দুর্বলতার কারণেই, রাজনৈতিক দল হিসাবে তার প্রতি সামাজিক বিরাগও তুলনায় দুর্বল। দ্বিতীয়ত, মতাদর্শের উগ্রতা বা অসহিষ্ণুতা এই দলের চরিত্রলক্ষণ নয়, বরং অনেক দূর অবধি নানা ধরনের মতামত এবং আচরণকে সঙ্গে নিয়ে চলাই তার স্বভাব, যে স্বভাব অনেক সময় অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলাকে প্রশ্রয় দিলেও একই সঙ্গে বিভিন্ন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে দলকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। প্রদেশ কংগ্রেসের নতুন সভাপতির প্রাথমিক মন্তব্যে তেমন নমনীয়তার কিছু আভাস মিলেছে। এ-কথা অনস্বীকার্য যে নমনীয়তা রাজনীতিতে অনেক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত যেখানে শাসকরা তার সুযোগ নিয়ে ছলে বলে কৌশলে বিরোধী বা ‘বন্ধু’ দলকে গ্রাস করে নিতে সতত তৎপর। কিন্তু ‘বিষয়-ভিত্তিক’ বিরোধিতার মূল শর্তটিকে অক্ষুণ্ণ রেখে শাসকের অন্যায়-অনাচারের প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে চললে কংগ্রেসের পক্ষে বিরোধী রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া অসম্ভব নয়, যেখানে নবজাগ্রত নাগরিক সমাজ তার সহায় হয়ে উঠতে পারে। বামপন্থীদের সঙ্গে কংগ্রেসের কেমন সম্পর্ক থাকবে বা থাকবে না, সেই প্রশ্নের উত্তরও ওই নতুন ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার্য। রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প। আপাতত প্রদেশ কংগ্রেসের সামনে শিল্পচর্চার সুযোগ এসেছে। সুযোগমাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy