E-Paper

ভোট-পানে চাহি

অপারেশন সিঁদুর-পরবর্তী বলীয়ান উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচারকে মেলাতে হবে কী ভাবে, নরেন্দ্র মোদী তার রূপরেখাটি অঙ্কিত করে গেলেন।

শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০২৫ ০৫:০৩

তবে কি, শুনি ওই রুনুঝুনু, ভোটের ধ্বনি? অবশ্য, পশ্চিমবঙ্গে এসে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এবং তাকে কেন্দ্র করে মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা বার্তা, তার মধ্যে নূপুরনিক্বণের বদলে মুগুরের প্রহারধ্বনিই বেশি শোনা গেল। ভোটপ্রচারের সুরটি এই সফরেই বেঁধে দিতে চাইলেন নরেন্দ্র মোদী, স্বভাবসিদ্ধ আক্রমণাত্মক বক্তব্যচয়নে। এই মুহূর্তে তিনি আক্রমণের প্রত্যয়ে বলীয়ান, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সাফল্য উদ্ধৃত করে ‘মন কি বাত’ ছাড়াও বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের ভাষণে তাঁর সেই প্রত্যয় ব্যক্ত। কৌশলী দক্ষতায় তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে বেঁধে ফেললেন ‘সিঁদুর’ অভিযানের সঙ্গে। বললেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’-কে এখনও সমাপ্ত বলা যায় না, দেশাভ্যন্তরেও সন্ত্রাসের সঙ্গে লড়াই চলছে, চলবে। যে রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি সেই লড়াই-এর প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ‘সমঝোতা’ করবে, তিনি বা তাঁরা আসলে সন্ত্রাসের সমর্থক। এ কথা বলার মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-শাসিত রাজ্যের প্রচ্ছন্ন উল্লেখ— বুঝ লোক যে জান সন্ধান। অবশ্যই এর সঙ্গে থেকেছে মুর্শিদাবাদ ও মালদহের সাম্প্রতিক ঘটনার অনুষঙ্গ, এবং তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হিংসার তাল মেলানোর অভিযোগ। তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রধান তাস— সংখ্যালঘু তোষণ। সেটিকে সন্ত্রাসতোষণের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার প্রয়াসে বিজেপি নেতারা ইতিমধ্যেই ব্যস্ত। প্রধানমন্ত্রী সেই প্রয়াসে সিলমোহর দিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে মুর্শিদাবাদের ঘটনায় পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতা, অক্ষমতা ও ক্ষেত্রবিশেষে স্বেচ্ছায় হাত গুটিয়ে থাকার বহু অভিযোগ উঠে এসেছে। তার সঙ্গে অপারেশন সিঁদুর-পরবর্তী বলীয়ান উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচারকে মেলাতে হবে কী ভাবে, নরেন্দ্র মোদী তার রূপরেখাটি অঙ্কিত করে গেলেন।

তবে কিনা, অনেক সময় জাতীয়তাবাদী প্রচারের উচ্চরবে অন্যতর জরুরি বিষয় ঢাকা পড়ে যায়, যে বিষয়গুলি রাজ্য ও রাজ্যবাসীর জীবনের সঙ্গে অধিকতর সম্পৃক্ত। প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য ও শিক্ষার দুর্নীতির কথা বললেন ঠিকই, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের হতাশ্বাস নাগরিকের কানে হয়তো তা আরও জোরালো ভাবে পৌঁছনোর দরকার ছিল। এ রাজ্যের নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যে ভাবে দুর্নীতি ও অনাচারের করাল গ্রাসে বিপর্যস্ত, তার বিরোধিতার জন্য যথেষ্ট উপাদান প্রধানমন্ত্রীর হালকা স্লোগানের অলঙ্কারমালায় পাওয়া গেল না। বাস্তবিক, পশ্চিমবঙ্গীয় বিজেপির কাজেকর্মে ইতিমধ্যে স্পষ্ট যে, স্থিতাবস্থার প্রতি নাগরিকের বিপুল আস্থাহীনতা সত্ত্বেও বিকল্প কোনও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি তৈরি করতে তারা ব্যর্থ। দলীয় সংগঠনেও তারা দুর্বল। নেতৃত্বহীনতাতে বিপন্ন। প্রধানমন্ত্রীর সফর এ সব ক্ষতে প্রলেপ দিতে পারল না।

ও দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে সব প্রতিযুক্তির অবতারণা করলেন, সেগুলি বহুশ্রুত, অতিচর্চিত এবং সেই কারণে, গুরুত্বহীন। রাজ্যের আর্থিক দুর্নীতি নিয়ে ‘পরিযায়ী পাখি’ প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ তুলছেন, এ দিকে রাজ্যের প্রাপ্য বিপুল পরিমাণ অর্থ (এক লক্ষ সত্তর হাজার কোটি টাকা) তিনিই আটকে রাখছেন— মুখ্যমন্ত্রী উবাচ। মুশকিল হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অভিজ্ঞ নেত্রীর অজানা থাকার কথা নয় যে, গত কয়েকটি নির্বাচনে এই কথাগুলি উপর্যুপরি ব্যবহারের চোটে ধার হারিয়েছে। কেন্দ্রের আর্থিক বঞ্চনার সামনে রাজ্যের ব্যাপক দুর্নীতি ও তোলাবাজির বিষয়টি লঘু হয়ে যায় না, বরং আরও গুরু-তর হয়ে দাঁড়ায়। সন্ত্রাসে রাজ্য সরকারের মদত দেওয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন কি না, তাঁরাই প্রমাণ করুন, কিন্তু ভিত্তি না থাকলেও ভোটার তালিকায় কারচুপির দায় তাঁর সরকার এড়াতে পারে না। এই তালিকা-কেলেঙ্কারির অনেকটাই স্থানিক স্তরে সংগঠিত, সুতরাং নজরদারির অভাব ও কারচুপির সঙ্গে রাজ্য ও দেশের নিরাপত্তার বিষয়গুলি ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত— মুখ্যমন্ত্রী নিজেও তা অবহিত। নিজের কাচের ঘরটি সামলে তবেই তাঁকে প্রত্যাঘাতের চেষ্টা করতে হবে। আগামী নির্বাচনী মরসুমে সেই কাজটি আগের মতো সহজ না-ই হতে পারে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Narendra Modi Operation Sindoor Nationalism Mamata Banerjee Scams

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy